‘আমাদের জীবন ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করতে নেমে যান’

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্ষণের এক মামলায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্য এবং তদন্ত কার্যক্রমে অসংগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার শুনানিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। নিঃশর্ত ক্ষমা চান সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ ১২ কর্মকর্তা।

মামলার তথ্যমতে, গত ৪ সেপ্টেম্বর বিকেল তিনটায় সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, এমন অভিযোগে শিশুটির বাবা ১১ সেপ্টেম্বর নাসিরনগর থানায় মামলা করেন। এতে ১৫ বছরের এক কিশোরকে আসামি করা হয়। মামলার আগে ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিশুটি নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ছিল। আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুটি (আসামি) ৩ নভেম্বর হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করে। তখন শিশুটির বয়স ও এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার বিষয়ে অসংগতি নজরে এলে আদালত কেস ডকেটসহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন। শিশুটিকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেওয়া হয়।

তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার সিডি (কেস ডকেট) আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসবের ওপর শুনানিতে মেডিকেল রিপোর্টে অসামঞ্জস্য ও তদন্ত কার্যক্রমে অবহেলার বিষয়টি নজরে এলে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশুটিকে আগাম জামিন দেওয়া হয়।


আজ অসামঞ্জস্য ও অসংগতি বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জনসহ নয়জন চিকিৎসক, জেলাটির পুলিশ সুপারসহ পুলিশের তিন কর্মকর্তার আদালতে হাজির হয়ে ওই বিষয়ে ব্যাখ্যা জানানোর দিন ধার্য ছিল।

শুনানিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘হাসপাতাল কি শুধু হাজিরা দেওয়ার জন্য? তিনটি সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তিন ধরনের বানান। এগুলো কি আপনারা করেছেন নাকি ক্লার্কেরা? আমাদের জীবন ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনারা ব্যবসা করতে নেমে যান। আমাদের জীবন আপনার অফিসের পিয়ন, চাপরাসি যারা আছে তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আপনারা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে যান।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার, নাসিরনগর থানার ওসি এবং ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উদ্দেশে আদালত বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হলো ১১-১২ বছর। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে লিখলেন ১২ বছর। কোন কর্তৃত্বে লিখলেন? মেয়েটির বয়স আট-নয় হতে পারে। ছেলেটির বয়স ১১-১২। এখানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় কি মামলা হয়?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় করা মামলায় আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর আগাম জামিন আবেদনের ধারাবাহিকতায় ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট আদেশ দেন। সেদিন হাইকোর্ট ভুক্তভোগী শিশুর মেডিকেল রিপোর্টে অসামঞ্জস্য এবং তদন্ত কার্যক্রমে ক্রটি বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জনসহ নয়জন চিকিৎসক এবং জেলার পুলিশ সুপারসহ পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। আজ তাঁরা আদালতে হাজির হন।

আরও পড়ুন

ক্ষমা চাইলেন ১২ কর্মকর্তা

তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, নাসিরনগর থানার ওসি এ টি এম আরিচুল হক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (উপপরিদর্শক) মো. আরিফুর রহমান। নয়জন চিকিৎসক হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন একরাম উল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা মো. একরামুল রেজা, মেডিকেল কর্মকর্তা মাহফিদা আক্তার ও জিনান রেজা (শিশু), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের কলসালট্যান্ট তোফায়েল হক ও জেনারেল হাসপাতালের ফরিদা ইয়াসমিন এবং নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শোয়েব মোহাম্মদ শাহরিয়ার, তানজিম তামান্না ও মো. শফিকুল ইসলাম।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দীন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম এবং চিকিৎসকদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া। আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. শাহ পরান চৌধুরী। শুনানি নিয়ে আদালত নয়জন চিকিৎসক ও তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে আপাতত ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ১১ মার্চ পরবর্তী শুনানির জন্য দিন রাখা হয়েছে।


পরে মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য পুলিশ সুপারসহ পুলিশের তিন কর্মকর্তা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।


চিকিৎসকদের আইনজীবী বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, মেডিকেল সার্টিফিকেটের ফরমে ক্রটি আছে বলে শুনানিতে সিভিল সার্জন উল্লেখ করেন।ভবিষ্যতে ভুল হবে না উল্লেখ করে নয়জন চিকিৎসক নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।

অসামঞ্জস্যতা

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দেওয়া ছাড়পত্রে বলা হয়েছে, তিন দিন আগে (৩ সেপ্টেম্বর) শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। সেখান থেকে দেওয়া আরেক রিপোর্টে বলা হয়, শিশুটির বাহ্যিক কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সদর হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরই আরেকটি তথ্য বলছে, জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন হয়েছে।

গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল

১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট ওই মামলায় ভুক্তভোগীর (শিশুর) ডাক্তারি পরীক্ষায় কোনো অনিময় হয়েছে কি না এবং তদন্তের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও গাফিলতি হয়েছে কি না তা উদ্‌ঘাটনে তিন সদস্যবিশিষ্ট পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে আদালতে পৃথক প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্যসচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের প্রতি ওই নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শকের পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন আজ আদালতে দাখিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই মামলার তদন্তে ক্রটি-বিচ্যুতি পেয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ ক্ষেত্রে নাসিরনগর থানার ওসি ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি পাওয়া গেছে।