আমাদের বাঁচান, আমরা টাকাটা ফেরত চাই

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

‘আমরা আমাদের টাকাটা ফেরত চাই,’ আদালতের কাছে এমন আরজি জানিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামাল। তিনি বলেছেন, ‘যতবারই আমরা আমাদের টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছি, তারা আমাদের কোনো যথাযথ জবাব দিতে পারছে না। আমরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।’

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের দখল করা প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে ৫০ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী নাশিদ কামাল।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার তদন্ত ও তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইন্টারপোলের কাছে পাঠানোর অগ্রগতিবিষয়ক শুনানিতে আজ রোববার এসব কথা বলেন নাশিদ কামাল। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই শুনানি গ্রহণ করেন।

নাশিদ কামাল ছাড়া পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারী আরও তিনজনের বক্তব্য শোনেন আদালত। শুনানি নিয়ে আদালত তাঁদের বক্তব্য লিখিত আকারে দাখিল করতে বলে ৫ জানুয়ারি পরবর্তী দিন রেখেছেন।

এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ বিদেশে পলাতক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার তদন্ত ও তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইন্টারপোলের কাছে পাঠানোর অগ্রগতি জানতে নির্দেশ দিয়ে ৩ জানুয়ারি দিন রেখেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি শুনানির জন্য ওঠে।

অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে ধরে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানিতে বলেন, ‘কয়েকজন ভুক্তভোগী এসেছেন, তাঁরা যদি শুনতেন।’ আদালত বলার অনুমতি দেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক। পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন।

‘আমরা কার কাছে যাব?’
আদালতে নাশিদ কামাল বলেন, ‌‘আমার চাচার বয়স ৮৪ বছর। তিনি পৌনে তিন কোটি টাকা রেখেছেন। ফুফু, তাঁর স্বামী ও ছেলে প্রায় তিন কোটি টাকা রেখেছেন। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে আমাদের টাকাটা ছিল। হঠাৎ করে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের দিকে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে থাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে নির্বাচন করা হয়। বাবা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল বেঁচে থাকতে প্রথমে তিনিই এখানে টাকা রাখেন। তাঁকে দেখে দেখে আমরা সবাই এখানে টাকা রাখি। আমরা যারা যারা টাকা রেখেছি, সরল বিশ্বাসে রেখেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দেখা করতে গিয়েছি, তারা চা–নাস্তা খাইয়ে বিদায় দিয়েছে। যতবারই টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছি, তারা কোনো যথাযথ জবাব দিতে পারছে না।’

নাশিদ কামাল আরও বলেন, ‘পি কে হালদারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ তাঁর সঙ্গে যোগসাজশ আছে, এ রকম অনেকের নাম আমাদের কাছে রয়েছে।’ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের টাকাটা ফেরত চাই। আদালতের কাছে এটিই আমাদের আকুল আবেদন।’

ওই ঘটনা শোনার পর তাঁর চাচার স্ট্রোক হয় জানিয়ে নাশিদ কামাল বলেন, ‘ফুফুও বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। তাঁরও অপারেশন হয়েছে। ফুফু, ফুফা ও তাঁদের ছেলে—তিনজনের টাকা এখানে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার পর যতবার ব্যাংকে যাচ্ছি, তারা বলছে কিছু জানি না। তাহলে আমরা কার কাছে যাব? কোথায় বিশ্বাস করব?’

‘আমাদের বাঁচান’
ক্যানসারে আক্রান্ত গৃহিণী সামিয়া বিনতে মাহবুব (৩৭) তাঁর ভোগান্তি ও কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর স্বামী দুজন মিলে এক কোটি টাকা রেখেছেন। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে পিপলস লিজিংয়ে টাকা রাখেন, কোম্পানিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত ও নিবন্ধিত। ক্যানসার ধরা পড়ার পর দুই বছর ধরে চাকরিতে নেই তিনি। করোনার কারণে স্বামীরও চাকরি নেই। এখন এতটাই কষ্টে দিনযাপন করছেন যে তিনি সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, ‘এক বছর যাবৎ আমি আমার সন্তানকে কোনো রকম মাছ–মাংস খাওয়াতে পারি না। আমাদের আয় নেই। এক কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত কোম্পানিতে রাখার পরে আজ আমি বিনা চিকিৎসায়। ৯ বছর বয়সী মেয়েকে একা রেখে নাহয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম কিন্তু আমি আমার সন্তানের নামে ওই টাকা রেখে যেতে চাই।’

পি কে হালদার ও তাঁর গং তো স্যুটকেস ভর্তি করে টাকা নিয়ে যায়নি উল্লেখ করে সামিয়া বলেন, ‘তাঁরা তো ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে গেছে। কেন কোনো রকম অ্যাকশন–রিঅ্যাকশন তাঁদের বিরুদ্ধে হবে না? আমরা আমানতকারী সরল বিশ্বাসে টাকা রেখেছি, আমরা কেন এত কষ্ট পাব। আমরা কেন এত নির্যাতিত হব? পিপলস লিজিংয়ে ৬ হাজার আমানতকারী, যেখানে অর্থের পরিমাণ ৭৫০ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন বরাদ্দ থেকেও আমাদের দিতে পারে। পিপলস লিজিংয়ের যে সম্পত্তি আছে, সেখান থেকেও দিতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করেছে, ওখানে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা তারা পেয়েছে।’

পরিস্থিতি সংকটময় উল্লেখ করে সামিয়া বলেন, ‘আমানতকারী ১১–১২ জন মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। তাঁরা প্রত্যেকে টাকার অভাবে আছেন। শুধু আমার কথা বলছি না, আমার মতো অনেক আমানতকারী আছেন, যাঁরা এখন রাস্তার ফকির।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে পথে পথে ঘুরছি টাকার জন্য। আমানতকারীরা নিগৃহীত। অথচ যারা ঋণখেলাপি তাঁরা কীভাবে একের পর এক টাকা নিয়ে যায়? এখন পর্যন্ত পি কে হালদারের ডানহাত, যাঁরা কাছের লোক, তাঁদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহেই কথা হয়।’

কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আমানতকারী সামিয়া আরও বলেন, ‘তাহলে এঁদের কেন ধরা হচ্ছে না। কান টানলে মাথা আসে। অন্তত এঁদের ধরেন। সংকটময় অবস্থা থেকে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে আদালত বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আমরা যারা আমানত রেখেছি, দেশের উন্নয়নের জন্য আমরা কেন কষ্ট পাব? আমরা এখানে কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছি, আমাদের বাঁচান। শুধু এটুকুই চাওয়া।’

আটকে আছে ট্রাস্টের ১০ কোটি টাকা
খালেদ মনসুর ট্রাস্টের পক্ষে মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, আমানতের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। ট্রাস্ট ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ট্রাস্ট্রের অনুদান, পরিকল্পনা ও কার্যক্রম তুলে ধরেন তিনি।

তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ট্রাস্টের সেবাগুলো স্থায়ী আমানতের আয় থেকে খরচ করা হয়। পিপলস লিজিংয়ে ১০ কোটি টাকা আটকা পড়ায় ট্রাস্ট্রের নিয়মিত আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষিত মানুষদের চাটুকারিতা বুঝতে পারিনি। আমাদের ১০ কোটি টাকা পিপিলস লিজিংয়ে আটকা পড়ে গেছে।’ ট্রাস্ট্রের টাকাগুলো উদ্ধার করে দেওয়ার আরজি জানান তিনি।

‘১৩ লাখ টাকা আমার কাছে আমার পদ্মা সেতু?’
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শওকতুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে অবসর ও অসহায় জীবন যাপন করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্য–সহযোগিতা নিয়ে পিপলস লিজিং তৈরি হয়েছিল বলে আশ্বস্ত হয়ে সেখানে কষ্টে উপার্জিত অর্থ রেখেছিলাম। টাকা আমানত হিসেবে রাখার উদ্দেশ্য ছিল সুষ্ঠুভাবে সন্তানের লেখাপড়া চালানো, ভালোভাবে বেঁচে থাকা, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা।’

শওকতুর রহমান আরও বলেন, ‘দেশটা স্বাধীন করেছিলাম একটা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। আমরা কি প্রতারিত হওয়ার জন্য দেশটা স্বাধীন করেছিলাম? আজ নিজের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে কষ্ট হচ্ছে। ভালো থাকার পরিবর্তে এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। আমার টাকা সামান্য হলেও ১৩ লাখ টাকা আমার কাছে আমার পদ্মা সেতু। এই টাকা এখন পর্যন্ত পাইনি। আদৌ পাব কি না, এই অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি এখনো পথে পথে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়োজিত একজন পর্যবেক্ষক পিপলস লিজিংয়ে ছিলেন উল্লেখ করে শওকতুর রহমান বলেন, ‘পর্যবেক্ষকের নাকের ডগায় পি কে হালদারের মতো অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তি বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভুগতে হচ্ছে আমাদের মতো অসহায় আমানতকারীদের। অর্থের অভাবে না পারছি নিয়মিত ভাত–রুটি জোগাড় করতে, না পারছি সন্তানদের লেখা পড়ার সুযোগ দিতে ও কোনো সামাজিকতা রক্ষা করতে।

সর্বোপরি অত্যন্ত মানসিক বিপর্যয় ও হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছি। আমি আমার টাকা ফেরত চাই। আকুল আবেদন—দুর্বিষহ এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর জন্য আদালতের যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত একান্ত কাম্য।’

১৮ নভেম্বর ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শিরোনামে একটি দৈনিকে ওই প্রতিবেদন ছাপা হয়। এই বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ১৯ নভেম্বর একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুল দিয়ে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ও গ্রেপ্তারে পদক্ষেপ বিষয়ে লিখিতভাবে দুদক চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের জানাতে বলেন। এর ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি ওঠে।

উল্লেখ্য, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার। তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তিনি কানাডায় আছেন।