আমাদের সম্পর্ক আস্থা, বন্ধুত্বের

ভোরের সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওঠেন এজেন্ট ও হকাররা। পাঠকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন প্রিয় প্রথম আলো। তাঁদের আনন্দ–বেদনার বিচিত্র গল্প নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র

বাক্প্রতিবন্ধী লিটন আহমদ প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেন প্রথম আলো। সিলেট নগরের ধোপাদীঘি এলাকা থেকে ১২ নভেম্বর তোলা
ছবি: আনিস মাহমুদ

৫২ বছর হয়ে গেল আমার সাংবাদিক–জীবনের। সরাসরি সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার যুক্ততা সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার মাধ্যমে, ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে। দেশে তখন ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন চলছে। সে বছর মে–জুন মাসে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে জানানো হয়েছিল যে পার্টির এক সদস্য, দরদি বন্ধু, চামড়া ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হায়দার চৌধুরী সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার অনুমোদন পেয়েছেন। পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল পত্রিকাটির সম্পাদক হবেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বজলুর রহমান, আমি হব ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। বজলুর রহমান তখন সংবাদ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। এই দায়িত্বের আগে কোনো পত্রিকা বা সাংবাদিকতা কাজের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা বা যুক্ততা ছিল না।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আমি দায়িত্ব পাই একতার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে। ১৯৯১ সালে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য আজকের কাগজ–এ কাজ করি। এরপর সম্পাদক–প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব নিই ভোরের কাগজ–এর। এখানে শুরুর দিকে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। পরে ১৯৯৮ সালে প্রথম আলোতে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই। প্রথম ১০ বছর প্রথম আলোর প্রকাশক ছিলেন মাহ্‌ফুজ আনাম। এরপর প্রকাশক হিসেবেও দায়িত্ব নিই আমি।

৫২ বছরের এই সাংবাদিক–জীবনে সাংবাদিকতাই শুধু শিখিনি, শিখেছি এর সার্বিক ব্যবস্থাপনাও। পত্রিকা প্রকাশে যেসব কাজ করতে হয়—সেটা প্রুফ রিডিং, গ্রাফিকস বা ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য কাজই হোক, সবই শিখতে হয়েছে।

সংবাদপত্রশিল্পে বিপুল পরিবর্তন চলছে। একটা আলোচনা হচ্ছে যে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমছে। অনলাইনে পাঠক বাড়ছে। মানুষ ক্রমশ ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে কিন্তু কাজ মোটেই কমেনি, বরং পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকসহ সবার কাজ বেড়েছে অনেক।

এ–ও অস্বীকার করা যাবে না যে এখনো বিপুল পাঠকের আস্থা–বিশ্বাস ও অভ্যস্ততা—সব ছাপা পত্রিকায়। সেই পত্রিকাটিকে সত্যিকারভাবে সফল করতে হলে পত্রিকাকর্মী, সাংবাদিক বা সম্পাদক–প্রকাশকের যেমন কৃতিত্ব থাকে, তেমনি কৃতিত্ব আছে আমাদের এজেন্ট ও হকার ভাইদের, যাঁরা পত্রিকাটিকে মানুষের বাড়ি বাড়ি, অফিসে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেন। রোদ–বৃষ্টি–ঝড় হোক, হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ বা অন্য যেকোনো সহিংস পরিস্থিতিই হোক, সব বাধা পেরিয়ে তাঁরা ভোরের আলো ফোটার আগেই পত্রিকাটি পাঠকের হাতে পৌঁছে দেন সযত্নে। যত ভালো কাগজই আমরা করি না কেন, তাঁরা যদি এটি না করতেন, তাহলে সব পরিশ্রমই বৃথা। তাঁদের কাজটি খুব কষ্টকর, কখনো কখনো ঝুঁকিরও।

এবার করোনা মহামারিকালে পত্রিকার বিক্রি কিছুটা কমে এসেছিল। তবু যেটুকু চলেছে, এজেন্ট–হকার ভাইয়েরা ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন বলেই। ধীরে ধীরে আবার পত্রিকা বিক্রি বেড়েছে—এ কৃতিত্বও তাঁদের। এটা আমাদের মানতেই হবে, নিজেদের সমস্ত শক্তি ও সময় তাঁরা ব্যয় করেছেন অফিস–বাসাবাড়িতে পত্রিকা পৌঁছাতে। তাঁরাই আমাদের ‘লাস্ট ম্যান’।

ভোরে পত্রিকা হাতে পেয়েই সাইকেলে করে ছোটেন তাঁরা। চট্টগ্রাম নগর থেকে তোলা
ছবি: জুয়েল শীল

সাংবাদিক–জীবনের অর্ধশতাব্দী ধরেই আমি এজেন্ট–হকারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছি। এখনো সেটা অব্যাহত আছে। পরস্পরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের, বন্ধুত্বের।

ভাবলে অবাক হতে হয় যে পরম্পরা মেনে ঐতিহ্যগতভাবেই অনেকে এই পেশায় আছেন। অনেকের বাবা, এমনকি দাদাও ছিলেন এই পেশায়। নারীরাও পিছিয়ে নেই। একই সঙ্গে তাঁরা সংসারের হাল ধরেছেন, আবার পত্রিকা এজেন্সিও চালাচ্ছেন। কেউ কেউ স্বামীর অবর্তমানে পত্রিকা ব্যবসার হাল ধরেছেন। এমনকি ৭৭ বছরের বৃদ্ধাও আমাদের পত্রিকা পৌঁছে দিচ্ছেন পাঠকের কাছে। হঠাৎ হঠাৎ কেউ এসে যখন জানান যে তাঁরা একতা পত্রিকাও বিক্রি করেছেন, আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তাঁদের প্রতি আমার বিশেষ ভালোবাসা ও অভিনন্দন।

কোভিডকালে আমরা এজেন্ট–হকারদের কাছে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পৌঁছে দিয়েছি। ছাপা কাগজে করোনা মহামারি ছড়ায় না—এই প্রচারেও এজেন্ট-হকাররা ছিলেন অগ্রগামী।

এ ছাড়া প্রথম আলোর তিনটি ম্যাগাজিন কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা, চলতি ঘটনাসহ বর্ণিল, ঈদসংখ্যা বা আরও কিছু বিশেষ ম্যাগাজিনের বিলিবণ্টনেও আমরা তাঁদের ওপর নির্ভরশীল। এতে আমরা উপকৃত হই, কিছুটা আয়ের পথ হয় তাঁদেরও।

এ বছরের শুরু থেকে এজেন্ট–হকারদের সংকট উত্তরণে আমরা পত্রিকার কমিশন বাড়িয়ে দিয়েছি। তাঁদের বিপদে–আপদে, ভালো-মন্দে পাশে থাকার চেষ্টা করি। অতীতে এজেন্টদের নিয়ে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ করেছি।

হকার ভাইদের নিয়েও নানা কিছু করার চেষ্টা করি। ঢাকা, বগুড়াসহ এলাকাভিত্তিক ফুটবল খেলার আয়োজন করেছি সফলভাবে। এটাকে ছড়িয়ে দিতে চাই সারা দেশে। এটা অস্বীকার করব না যে গত দুই বছরে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা কমে এসেছিল। তবে সারা দেশে সাংবাদিকেরা বা সার্কুলেশন বিভাগের লোকজন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, আলোচনা করেছেন। এখনো অব্যাহত আছে সেসব। এই দুই বছরে অনেক কিছু করতে না পারলেও আবার শুরু করার চিন্তাভাবনা করছি। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯—এই চার বছর ধরে এজেন্ট–হকারদের ৪০ জন ছেলেমেয়েকে (যাঁরা জিপিএ–৫ পেয়েছে) আমরা বৃত্তি দিয়েছি। সেটাও নতুন করে শুরু করব আবার।

প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপিত হলো। এ উপলক্ষে হকার–এজেন্ট ভাইদের নিয়ে এবার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হলো। তাঁদের কথা আমরা বিশেষভাবে জানাতে চাই দেশবাসীকে। আমরা চাই, পাঠক আরও জানুক তাঁদের সম্পর্কে। তাঁদের শ্রদ্ধা করুক। এই শুভ সময়ে হকার–এজেন্টদের প্রতি জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা।

মতিউর রহমান: সম্পাদক