আমাদের সোনার পদকের কী হবে

গণিত উৎসবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জামিলুর রেজা চৌধুরী, ২০০৯

২০০১ সালে প্রথম আলোয় এক অভিনব গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি। জাফর স্যার (অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল) ও কায়কোবাদ স্যার (অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ) মিলে শুরু করেন নিউরনে অনুরণন। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। সেটার সমাপনী অনুষ্ঠানে স্যার যোগ দেন। সেখান থেকে ফিরে গণিত অলিম্পিয়াডের একটা কমিটি করার কথা ভাবি। কমিটির কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্যারের কথা মনে হলো। স্যার তত দিনে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। গিয়ে বললাম, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যেতে হলে আমাদের একটা ন্যাশনাল সিলেকশন কমিটি লাগবে। আপনি যদি কমিটির সভাপতি হন, তাহলে আমরা এগোতে পারি। স্যার সব শুনলেন। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও দুজনকে রাখতে বললেন। ক্যালেন্ডার দেখে মিটিংয়ের একটা তারিখ দিয়ে দিলেন।

শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশসহ বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের সব উদ্যোগে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন অগ্রগামী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের মিটিং হলো ২০০৩ সালের ১৩ এপ্রিল, মহাখালীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের কক্ষে। হলো বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ব্যস, শুরু হয়ে গেল স্যারের সঙ্গে আমার গণিত অলিম্পিয়াডের কাজ। আমৃত্যু স্যার আমাদের কমিটির সভাপতি ছিলেন।

২০০৪ সালে নটর ডেম কলেজের অডিটরিয়ামে সমাপনী পর্বে সভাপতির ভাষণে স্যার গণিত অলিম্পিয়াডকে ঘিরে নিজের তিনটি স্বপ্নের কথা বলেন, ২০১০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে পদক জয়, ২০২২ সালের মধ্যে কোনো এক বাঙালির গণিতে ফিল্ডস মেডেল ও ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।

সিলেটের আয়োজন থেকে স্যার প্রতিবছর ঢাকার উৎসবের সকালে, জাতীয় উৎসবের প্রথম দিন সকালে ও দ্বিতীয় দিন পুরস্কার বিতরণীতে উপস্থিত থাকতেন। উদ্বোধনের পর পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই সেন্ট যোসেফ স্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনে বসতাম। সেখানেই স্যার কিছু নির্দেশনা দিতেন।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
ছবি: জাহিদুল করিম

স্যার যত দিন ব্র্যাকে ছিলেন, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির মিটিং ওখানেই হতো। আমরা বছরে মাত্র দুটি মিটিং করতাম। ২০১০ সালের পর মিটিং নেমে আসে একটিতে এবং সেটা হয় স্যারের বাসায়। স্যারের বাসায় মিটিংয়ে আমরা যারা কনিষ্ঠ, তাদের আর একটা লাভ হতো। সেটা ম্যাডামের বানানো হাজার রকমের খাওয়া। সেখানে একদিন স্যার বলতে শুরু করলেন, ১৯৫০ সালে প্রথম হন আবদুল মতিন পাটোয়ারি (পরে অধ্যাপক, বুয়েটের উপাচার্য, বর্তমানে অবসরে আছেন)। তারপর গড়গড় করে বলে গেলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত! আমার মনে আছে, মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহারের আগপর্যন্ত স্যার তাঁর পরিচিতদের ফোন নম্বর বলতে পারতেন।

আমাদের যেকোনো নতুন পরিকল্পনা হলেই আমি স্যারের কাছে যাই। সর্বশেষ গিয়েছি ইন-জিনিয়াসের পরিকল্পনা নিয়ে। স্যার শুনে বললেন, করতে পারো। তারপর তৎক্ষণাৎ বললেন, দেশের কোথায় কোথায় পুরকৌশলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কী রকম প্রতিযোগিতা হয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী কী হয়। ফেরার সময় আমার মনে হয়েছে, দুজনকে কাজে লাগিয়ে এক মাস সময় নিয়ে আমরা যেসব তথ্য–উপাত্ত জোগাড় করেছি, সেটা স্যারের কাছেই ছিল।

শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশসহ বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের সব উদ্যোগে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন অগ্রগামী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

২০২০ সালের গণিত অলিম্পিয়াড নিয়েই স্যারের সঙ্গে শেষ কথা হয় মার্চের শেষের দিকে। বললেন, মুনির, তাড়াহুড়া কোরো না। আইএমও কী করে, সেটা দেখো। আমরা যা করব, ভেবেচিন্তেই করব।

গণিত অলিম্পিয়াডে ধীরে, ধীরে, সর্পিলাকার পদ্ধতিতে টার্গেট একটু একটু করে এগোতাম। কমিটির স্যাররা প্রায় সবাই আমার আর আমাদের কোচ মাহবুব মজুমদারের এই ধীরে চলা নীতি মেনে নিয়েছেন। ২০০৯ সালে, স্যারের বেঁধে দেওয়া সময়ের এক বছর আগেই আমরা প্রথম পদক পাই। ২০১২ সালে রুপার পদক পাওয়ার পর স্যার একদিন বললেন, আমাদের সোনার পদকের কী হবে, মুনির?

বলতাম সময় লাগবে। তবে ২০১৮ সালে রোমানিয়ায় যাওয়ার আগে স্যারদের বলে গিয়েছি, এবার হবে স্যার। হলঘরে ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে স্যারকে সবার আগেই ফোন করি। স্যার ফোন ধরেই বললেন, অভিনন্দন। তোমার ফোন পেয়েই বুঝেছি আমাদের জন্য সুখবর। স্যার জানতেন, ওই সময়ে ফলাফল ঘোষিত হবে, তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন আমার ফোনের।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে আরও অনেক সাফল্য বয়ে আনবে। কিন্তু ফোনের এপারে অভিনন্দন বলার জন্য আমাদের জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার থাকবেন না।

মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি