আমার করোনাকাল কিংবা অভিজ্ঞতার বাঁক বদল

প্রতীকী ছবিপ্রথম আলো

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনবাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

এইতো সেদিন। একটি লেখা পড়ে মনে ধরে খুব। ২০ আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় সাহানা নার্গিসের লেখা করোনাকালের জীবনগাথা, ‘আবার কবে গ্রামে যাব’, পড়ে আমার মনে হয়েছে লেখিকা আমাদের সবার মর্মবেদনাটুকুই যেন তাঁর লেখায় নিপুণ হাতে চিত্রিত করেছেন। তাঁর দৈনন্দিন হতাশার চিত্র যেভাবে তিনি চিত্রায়িত করেছেন, তা আমাদের সবার বর্তমান জীবনযন্ত্রণার অবিকল বহিঃপ্রকাশ।
আসলে করোনাভাইরাস আমাদের চিরায়ত জীবনচর্চাকে এই কমাসেই দুমড়েমুচড়ে তছনছ করে দিয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা বাংলাদেশে সবার জীবন ও জীবিকা, অর্থনীতি, সামাজিক বিপর্যয় প্রভৃতি এই অতিমারিতে একই সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। এখানে, ধনী-গরিব, উন্নত-অনুন্নত বলে কোনো কথা নেই।
আমি একজন অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। ৩৪ বছর চাকরি করার পর অবসরজীবনে নিজেকে চলমান রাখার জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপনে একটা নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

ঘুম থেকে উঠেই মর্নিং বার্ডসের (আমাদের প্রাতর্ভ্রমণ ক্লাব) বন্ধুদের সঙ্গে রোজ হাঁটতে বের হতাম। বুকভরা নিশ্বাস, প্রাণভরা আনন্দ নিয়ে যখন ঘরে ফিরতাম, নিজেকে একজন প্রাণবন্ত মানুষ মনে হতো। করোনার আক্রমণে প্রাতর্ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেল।
দিনের পরবর্তী কার্যক্রমে পত্রিকা বা বই পড়া প্রভৃতি অনিবার্য ছিল। প্রথম আলো আমার পছন্দের পত্রিকা। এটি পড়ে প্রতিদিন অন্তত ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটাতাম অনায়াসে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সিলেটে সংবাদপত্রের হকারেরা করোনা সংক্রমণের ভয়ে পত্রিকা বিলি করাও বন্ধ করে দেয়। বয়সের কারণে টেলিভিশনের পর্দায় বা ল্যাপটপে অনেকক্ষণ চোখ রাখা যায় না। তাই হঠাৎ করেই জীবনে স্থবিরতা নেমে এল। নিজেকে সচল রাখতে বাড়ির ছাদে নিজের মতো করে একটি ‘ওয়াকিং ট্র্যাক’ তৈরি করে নিলাম। তাতে করে হাঁটার কাজ কিছুটা সমাধান হলেও, নিঃসঙ্গতা কেন যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না। বাঙালিরা আড্ডাপ্রিয় জাতি। আড্ডা থেমে গেলে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
দুপুরে কিছুটা সময় বাজারে গিয়ে কাটানো যেত। সেখানেও বাধা। ঘরে মেয়ে- জামাই চিকিৎসক। তাদের কড়া নির্দেশ, কোনো অবস্থায়ই আমার বাইরে যাওয়া হবে না।
একটা সময় আমার কথা তাদের কাছে নির্দেশ সমতুল্য ছিল। এখন তাদের কথা আমার মানতে হয়। এটাই জীবনের ধর্ম।

বিকেলে প্রায় দিনই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সময় কাটাতাম। এখন সেটাও বন্ধ। তাই দিনের ২৪ ঘণ্টাই গৃহবন্দী। সত্তরোর্ধ্ব জীবনে এ রকম অবস্থা আর কখনো হয়নি। ১৯৭১-এ যখন শরণার্থী হয়ে ভারতে ছিলাম, তখনো এ রকম অন্তরীণ ছিলাম না। সারাক্ষণই মানুষের সান্নিধ্যে ছিলাম।
আমার জীবনসঙ্গিনী তাঁর ছাদবাগান, ঘরকন্না নিয়ে অনেক সুন্দর দিনাতিপাত করছেন । আমি তাঁর কাজে যোগ্য সঙ্গী হতে পারলে হয়তো নিঃসঙ্গতা কিছু কমত। কিন্তু ওই কাজটা আমি তাঁর মতো করে করতে পারি না।
ঘরে নাতি-নাতনি দুটো আছে। এদের স্কুল বন্ধ। যাঁরা গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁদের আসাও বন্ধ। কত দিন তাঁরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে, হিসাব রাখাই মুশকিল।
যত দিন স্কুল খোলা ছিল, আমার একটা চাকরিও ছিল। দিনে অন্তত দুবার সিঁথি (নাতনি) অথবা শুদ্ধ (নাতি) কাউকে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব আমার ছিল। শুধু কি তা-ই? গানের ক্লাস, আর্টের স্কুল, কোচিং সেন্টারে যাওয়া—সবখানেই আমি ছিলাম স্পেয়ার হুইল। এখন সেই স্পেয়ার হুইলটি পরিত্যক্ত। একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য। মাঝেমধ্যে দু-এক দিনের জন্য বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া এটা প্রায় রুটিনের মতোই ছিল। এখন সবই বন্ধ। শুদ্ধকে নিয়ে ক্রিকেট কোচিং, সুইমিংপুলে যেতাম, সেটাও বন্ধ।

আহা! এই সমস্ত পেশায় যুক্ত থেকে যে মানুষগুলো জীবিকা অর্জন করতেন, তাঁরা ঘরে বসে বেকারত্বের স্বাদ গ্রহণ করছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই এখন অনেক অর্থকষ্টে আছেন! অথচ জীবনে কারও কাছে তাঁদের কখনো হাত পাততে হয়নি। সরকারি অনুদান তো সবার কাছে পৌঁছার কথা নয়। আর যদিও পৌঁছায়, তা কি যথেষ্ট?
আমার নাতি-নাতনিরাও এখন অসহায়। তারা যখন তাদের হতাশার কথা বলে, তাদের বন্ধুদের কথা বলে, স্কুল কবে খুলবে? আবার কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে জিজ্ঞেস করে, তখন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকতে হয়।
তাদের খুশি এবং ব্যস্ত রাখতে একটি ক্যারম বোর্ড কেনা হয়েছে। তাদের দু-তিন ঘণ্টা ব্যস্ত রাখার জন্য এটি একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু একটানা খেলাধুলায় কিছু অশান্তিও আছে। তাদের খেলাধুলায় সব সময় সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমরা বুড়ো-বুড়ি ছাড়া কেউ নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন-তখন তাদের খেলার সঙ্গী হতে হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয় না। খেলায় সঙ্গী নির্বাচন নিয়ে প্রায় সময়ই গোলমাল হয়। কখনো লটারি, কখনো সিলেকশন। তার পরও খেলায় হারজিত নিয়ে রোজ ঝগড়া হয়। একধরনের ছোটখাটো হাতাহাতিও হয়। এটা নিত্যদিনের ঘটনা। তবুও খেলা বন্ধ হয় না। এভাবেই আনন্দ উৎকণ্ঠায় কাটে আমাদের দিনরাত্রি।

আমার একটা নেশা ছিল ফেসবুকে লেখালেখি। প্রায়ই ‘নিধিরামের রোজনামচা’ শীর্ষক একটি লেখা ফেসবুকে লিখতাম। কেউ কেউ লেখাটি পছন্দ করে কমেন্টে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতেন। করোনার তাণ্ডবে তা-ও আর ভালো লাগে না। মন এবং কলম একসঙ্গে চলতে চায় না।
প্রতিনিয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুসংবাদ শুনতে আর ভালো লাগে না। গত ৫ মাসে অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও অনেকের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়েছে, যাদের শেষকৃত্যে উপস্থিতি ছিল অনিবার্য ছিল কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য তা-ও হয়ে ওঠেনি। অন্য অনেকের মতোই এই অনুতাপ সারা জীবন বইতে হবে।
অনিবার্য কারণে কোনো দিন বাইরে গেলে দেখতে পাই মানুষ মাস্ক না পরে নির্বিঘ্নে যেখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করছে। দুজন রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা মাস্ক পরে না কেন? একজন আমাকে সরাসরি জবাব দেয়, কী জন্য পরবে? অন্যজন বলে, মাস্ক পরে সে রিকশা চালাতে পারে না।
আজকাল হাঁচি শিষ্টাচার, কাশি শিষ্টাচার, শারীরিক দূরত্ব ইত্যাদি খুবই প্রচলিত শব্দ। গণমাধ্যমে সচেতনতার জন্য এই শব্দগুলো প্রতিদিন আলোচিত হয়। তাতে খুব কাজ হয়েছে কি? এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তরকারির বাজারে মাস্ক না পরা এক লোক প্রকাশ্যে এমনভাবে হাঁচি দেয়, যার কিছু অংশ আমার শার্টের কলারে এবং হাতে এসে পরে। লোকটা নির্দ্বিধায় আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। কোনো দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করল না। লজ্জায় এ কথা কাউকে বলিনি। এরপর এক সপ্তাহ আমার মনে হয়েছে আমারও করোনা হয়ে যাবে। রাতে মনে হতো, গলা ব্যথা করছে। খানিকটা জ্বর জ্বর লাগত। কাউকে না বলে গরম জল, লেবুর রস ইত্যাদি বারবার খেয়েছি, আর আদা, লেবুমিশ্রিত চা। একদিন দুটো প্যারাসিটামল একসঙ্গে গিলে খেয়েছি।

সাহানা নার্গিস ঈদে বাড়িতে যেতে না পারার জন্য অনেক আফসোস করেছেন।
আমরা কিন্তু কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে ঈদুল আজহার ছুটিতে সবাইকে নিয়ে নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়িতে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল সেখানে বিবিয়ানা নদীতে সাঁতার কাটা, নৌকায় করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, আর সকালবেলা নদী তীরের বাজারে মাত্র ধরে আনা জীবিত মাছ কিনে টাটকা দেশি মাছের স্বাদে রসনা তৃপ্ত করা।
সবই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু আমরা যখন সকলে মাস্ক পরে বাড়িতে পৌঁছালাম, গ্রামের লোকজন তো দেখে অবাক। তারা বলে, এখানে তো করোনা নাই। এগুলো বড়লোকদের রোগ। আমরা যত বেশি স্বাস্থ্যসচেতন থেকেছি, গ্রামের লোকজন আমাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছে। মনে হয়েছে দূর থেকে কেউ কেউ আমাদের নিয়ে ব্যঙ্গোক্তিও করেছে। তারা মনেই করেছে এটা আমাদের বাড়াবাড়ি।
এক সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রচারিত করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বুলেটিন সবাই মিলে শুনতাম। কী কারণে জানি সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

অবশ্য টেলিভিশন টক শো আগের মতোই চলছে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মুখ থেকে ভালো ভালো কথা শুনে সমৃদ্ধ হই, আশান্বিত হই। আবার কোনো কোনো দায়িত্বসম্পন্ন বিজ্ঞজনেরা যখন দায়িত্বহীনের মতো মনগড়া কথা বলেন এবং যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, তখন মনে মনে কষ্ট পাই। এ জন্য কাউকে দোষী করি না। দোষ চাপিয়ে দিই করোনাভাইরাসের ওপর। কারণ করোনা না এলে তো এই দায়িত্বহীন কথাগুলো আমাদের শুনতে হতো না।
বাড়িতে থাকার সময় প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগে নাতি-নাতনিদের নিয়ে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেড়িয়েছি। ঈদের ছুটির কারণে রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে। রাস্তার দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতগুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা নানা জাতের বৃক্ষগুলো জেগে থাকে প্রহরীর মতো। বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের ফাঁকে ফাঁকে, মাছরাঙা, বক, চিল, শালিক, পানকৌড়ি, ফিঙেসহ আরও নাম না জানা পাখিরা যখন তাদের দিনের শেষ খাবারটুকু সংগ্রহে ব্যস্ত, ঠিক তখনই অস্তমিত সূর্যের রঙিন আভা বিশ্বচরাচরের ন্যায় আমার আমাদের সম্মোহিত করে ফেলে। অন্ধকার হয়ে আসছে, তবুও তারা ঘরে ফিরতে নারাজ। শুদ্ধ মোবাইলের ক্যামেরায় দৃশ্যগুলো ফ্রেমবন্দী করতে করতে বলে ‘চলো না আরও কদিন গ্রামেই থাকি!’
করোনাভাইরাস একদিন হয়তো চলে যাবে অথবা কোনো দিনও যাবে না। কিন্তু পৃথিবীটাকে এমনভাবে বদলে দেবে যা মানবসমাজ আগে কখনো কল্পনাও করেনি।
সবকিছুর পর আবারও পৃথিবী হোক সুন্দর, নিরাপদ এবং মানবিক।


*লেখক: নীরেশ চন্দ্র দাশ, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা