আমার বাঙালি মা

রওশন জামিল

রওশন জামিলের মেয়ে—এই পরিচয় দিতে আমি গর্ববোধ করি। কারণ জীবন কী, জীবনের সৌন্দর্য কী, মানবিকতা কী জিনিস, কীভাবে অল্পে খুশি থাকা যায়—এ সবই আমি শিখেছি মায়ের কাছে। শুধু আমি কেন, আমরা সব ভাইবোনই তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি ছিলেন পজিটিভ মানুষ। আমাদের প্রতি তাঁর কথা ছিল, বেঁচে থাকাকে আনন্দময় করে তোলো, সময়ের মূল্য দাও, কাজের মধ্য দিয়ে আনন্দ খোঁজো। নিজের জীবনেও তিনি এমনই ছিলেন। সব সময় কাজের মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। এখন মাকে নিয়ে লিখতে বসে কত কিছু যে মনে আসছে! সকালে বা দুপুরে কখনো মাকে ঘুমাতে দেখলে চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতাম আমরা। ভাবতাম, তাঁর কি শরীর খারাপ? কেননা, মাকে তো কখনো কাজ ছাড়া দেখিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই যথাযথভাবে উদ্‌যাপন করে গেছেন তিনি। তাঁকে দেখেই শিখেছি আমরা। কী শিখেছি, তা জানা যাবে তাঁর জীবনের গল্পটি বললেই। তাই প্রথমেই বলে যাক তাঁর লড়াই–সংগ্রামের গল্প।

মা যখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এসেছেন, সে সময় একজন মেয়ের এই প্রাঙ্গণে পা রাখাটা খুব সহজ ছিল না। বাধা ছিল প্রতি পদে পদে। ব্রিটিশরাজের শাসনামলে তাঁর জন্ম। বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানি আমলের বিরুদ্ধ–পরিবেশে। আমার নানাবাড়িতে সেই সময়ে গানবাজনার চল ছিল। তবে তা হতো খুবই ঘরোয়া পরিবেশে, নিজেদের মধ্যে। এমন একটি সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠার পারও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থাকার জন্য তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে। স্কুলে ভর্তি হয়ে একসময় নাচ শেখার ইচ্ছা হয় মায়ের। কিন্তু সেকালের রক্ষণশীল বাস্তবতায় মুসলমান পরিবারের একজন মেয়ে নাচ করবে, এটা তাঁর পরিবার মানবে কেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা তা মানেনি। তাই প্রথম দিকে উপায় না পেয়ে মা স্কুলে অন্যদের নাচের ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে নাচ দেখতেন। পরে বাড়ি এসে সেগুলো অনুশীলন করতেন। এভাবেই তিনি নাচ শিখতে থাকেন। এর মধ্যে একদিন একটি ঘটনা ঘটল। নাচের এক অনুষ্ঠানে একজন হিন্দু মেয়ে হঠাৎ অনুপস্থিত ছিলেন। সেটা জানতে পেরে মা আমার নানিকে বললেন, ওই হিন্দু মেয়ের নামে তিনি নাচতে চান। সে সময় অনুষ্ঠানে নাচার ব্যাপারে নানিকে তিনি রাজি করিয়েছিলেন এই বলে যে মেকআপ নিয়ে নাচলে কেউ তাঁকে চিনতে পারবে না। এভাবেই নিজের পরিচয় গোপন করে মঞ্চে নাচলেন মা। পরে তাঁর আগ্রহ দেখে নানাবাড়িতে নাচের শিক্ষক রাখা হয়েছিল, কিন্তু বাইজিরা যেভাবে নাচেন, শিক্ষক তাঁকে সেই সব ভঙ্গিমায় তালিম দিচ্ছিলেন। এতে এই নাচের মধ্যে পরিবারের কেউ কেউ অশ্লীলতার গন্ধ পেলেন। ফলাফল, রেগেমেগে তাঁরা মায়ের নৃত্যশিক্ষা বন্ধ করে দিলেন।

মায়ের নাচ শেখার গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। তবে নিয়তি হয়তো অন্য রকম চেয়েছিল। তখন আমার ছোট খালা আলপনা মমতাজের বয়স কম ছিল। মা তাঁকে নিয়ে যেতেন নাচের স্কুলে। সেখানেই আমার বাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পরে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর বাবার ইচ্ছাতেই ভালোভাবে নাচ শিখে নাচতে থাকেন মা। তাঁর একমাত্র শখ পূরণ হলো। এ সময়ই প্রথমবারের মতো যেন নিজের ভালো লাগার জগতের সঙ্গে একাত্ম হতে পেয়েছিলেন তিনি।

আমার মায়ের ব্যক্তিত্বর মধ্যেই নিজে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার একটা প্রত্যয় ছিল। পরিবারের বোঝা হয়ে তিনি থাকতে চাইতেন না। ঠিক একই শিক্ষা মা আমাদের দিয়েছেন। বলতেন, ‘জীবনটা এত সোজা নয়। তোমাদের প্রতে৵ককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জীবন তোমাদের নিজেদের হাতে।’ শৈশবে বুঝতে শেখার পর এই কথাগুলো তিনিই আমাদের মগজে ঢুকিয়েছিলেন। সেই ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে নারীরা কাজ করবে, স্বাবলম্বী হবে, পুরুষের পাশে এগিয়ে চলবে—এমনটা ভাবা একটু দুষ্করই ছিল।

এ বাস্তবতা অনুধাবন করে প্রথমেই মা ভাবলেন, মেয়েদের জন্য একটা মজবুত হাতিয়ার দরকার। এটাই সমাজে অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করবে। আমাদের তিন বোনকে তিনি ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করালেন। আর দুই ভাইকে দিলেন বাংলা স্কুলে। তবে আমাদের পড়াশোনা নিয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল খরচ। আমাদের সব ব্যয় বহন করার ক্ষমতা সে সময় বাবা–মায়ের ছিল না। কিন্তু ঝুঁকি নিয়েই মা আমাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করলেন। সব ভাইবোনের পড়াশোনা শুরু হওয়ার পর সংসারের খরচ লাগামহীন বাড়তে থাকে। এ সময় বাবাকে সহযোগিতা করতেই নাচের পাশাপাশি রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু করেন মা। তবে সেখানে পারিশ্রমিক ছিল অনেক কম। ফলে অর্থ উপার্জনের জন্য একসময় খানিকটা বাধ্য হয়েই তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। এসব পাকিস্তান আমলের কথা। তার কিছুদিন পর নজরুল ইসলাম নামে আমাদের পরিচিত এক কাকা আলিবাবা নাটকে মায়ের অভিনয় দেখে তাঁকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব শুনে প্রথমে মা লজ্জা পেয়েছিলেন। সিনেমায় সে সময় যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁদেরকে সমাজে একটু ভিন্নভাবে দেখা হতো। তাই এখানে অভিনয়ের কথা শুনে মায়ের লজ্জা পাওয়াটা হয়তো সংগতই ছিল। পরে নজরুল কাকা তাঁর ভুল ভাঙালেন। বললেন, এখানে অনেকটা পরিবারের মতো করে কাজ হয়। সবাই মিলে শুটিং হয়। তখন আমরাও বললাম, সিনেমায় অভিনয় করো, মা। এরপরও মা সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি হননি। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের ভাগ্য জড়িত ছিল! অগত্যা আমাদের জন্যই মা ঘর থেকে বের হলেন, শুরু করলেন শুটিং। আসলে মা অভিনয়টা ভালোবাসতেন। আমার মায়ের নানি ছিলেন সিনেমার ভক্ত। তিনি স্কুল থেকে মাকে নিয়ে বিভিন্ন সিনেমা দেখতে যেতেন। আর বাড়ি ফিরে মা সেসব সিনেমার মতো নিজের মনের আনন্দে নাচতেন। এসব আমরা মায়ের মুখেই শুনেছি।

এই গল্পগুলো বললাম এটা বোঝাতে যে আমাদের জন্যই, আমাদের সচ্ছলতার জন্য নৃত্যশিল্পী রওশন জামিল অভিনয়মুখী হয়েছিলেন। এই গল্পের ভেতরেই তাঁর জীবনের লড়াইেয়ের রেখাচিত্র আঁকা আছে।

আগেই বলেছি, টানাটানির সংসার ছিল আমাদের। এর মধ্যেই মা চেষ্টা করতেন আমাদের খুশি রাখতে। সাধারণ একটি খাবার হলেও অসাধারণ পরিবেশনা থাকত সবকিছুতে। আমাদের ঘরে দামি কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু যা ছিল সবকিছুর সঙ্গেই মায়ের হাতের কাজের ছাপ থাকত। কোনো কাজকেই তিনি তুচ্ছ মনে করতেন না। রান্না থেকে সেলাই—সবই নিজের হাতে করতেন। আমাদের বলতেন, বাসার কাজের লোকদের সম্মান করবে। চারপাশে নারীদের অনেক বিষয় নিয়ে কানাকানি হলেও তিনি কখনো আমাদের সেসব বলতেন না। চারপাশের হীনম্মন্যতা তাঁর সন্তানদের মনকে ছোট করে দিক—এটা তিনি চাইতেন না। আমরা তিন বোন যখন লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠছিলাম, সেই সময় বহু কষ্টে আমাদের বাড়তে পানি জুগিয়েছিলেন মা। ইচ্ছেমতো পেশায় যাওয়ার সুযোগ পেলাম আমরা। মত প্রকাশের অধিকার পেলাম। সেই সময় মায়ের সাহসী ভূমিকা নারী থেকে আমাদের মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমার জীবন, কর্ম, আদর্শ—সব জায়গায় এখনো জড়িয়ে আছেন মা।

১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া মনের মতো বউ সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয় হন মা। এর পরের বছর তাঁর ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায় জীবন থেকে নেয়া। তারপর থেকে নিয়মিত মা আমাদের জন্য সিনেমায় অভিনয় করে গিয়েছেন। এভাবেই তিনি সংসারের হাল ধরতে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন একজন সু–অভিনেত্রী। সূর্য দীঘল বাড়ি, তিতাস একটি নদীর নাম, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমণি, জননী, মাটির ঘর, চিত্রা নদীর পারে প্রভৃতি সিনেমা তাঁকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে। সবাই মায়ের অভিনয়ের প্রশংসা করতেন। তিনি শুটিং থেকে ফিরলে শুটিংয়ের গল্প শোনাতেন। গোলাপি এখন ট্রেনে সিনেমার একটি দৃশ্যে বেশ কয়েক দিন অভুক্ত থাকার পর মা খাচ্ছে—এমন একটি দৃশ্য ছিল। সেই দৃশ্যটি দেখে সবাই কেঁদে ফেলেছিলেন। মাকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি যে কান্না করো, এটা কীভাবে করো? অনেক মানুষের সামনে কাঁদা যায়? মা উত্তর দিয়েছিলেন, তোমরা বাসায় কী করছ, কী খাচ্ছ, তোমাদের ভাইবোনদের চিন্তা করলে এমনিতেই চোখে পানি চলে আসে।

আমার মা অনেক গুণী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কারও কারও আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তাঁরা ভালো কাজ রেখে বাণিজ্যিক সিনেমা বানানো শুরু করলেন। মা তখন খুব কষ্ট পেতেন। আবার টেলিভিশনে ১৯৯০ দশকের দিকে চরিত্রাভিনেতা থেকে বের হয়ে নাটকের গল্প হয়ে যেতে থাকে নায়ক–নায়িকানির্ভর। এ সময়ও মাকে আফসোস করতে দেখেছি। কারণ, দৃশ্য থাকত কম। অভিনয় দেখানোর সুযোগ থাকত না। তখন মা ভাবতেন, সরকারি সব সুবিধা আছে। তবুও বিটিভি কেন ভালো নাটক বানাতে পারে না। শেষ বয়সে তিনি ভালো চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করতেন। মা ছিলেন ভালো চরিত্রের কাঙাল। তবে মায়ের অভিনয়জীবনের শেষটা ভালোভাবে কেটেছে। জীবনের শেষ অভিনীত গল্পে তিনি ছিলেন প্রধান অভিনেতা। তাঁকে ভেবেই গল্প লেখা হয়েছে। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং নারী অগ্রগতির জন্য তিনি বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালদের সঙ্গে সম্মাননা পেয়েছেন। আফসোস, তিনি অনেক সম্মাননা দেখে যেতে পারেননি।

মা–ই প্রথম শিখিয়েছিলেন, আমরা প্রথমে মানুষ, তারপরে বাঙালি। সব সময় তাঁকে দেখতাম বাঙালিয়ানার আদর্শ ধারণ করতে। এ দেশের প্রতি তিনি আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। আমাদের ভেতরে সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ তৈরি করেছেন তিনিই। গর্বের সঙ্গে আমরা এখনো যখন বাঙালি সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ করি, তখন আর কাউকে নয়, মনে পড়ে আমাদের বাঙালি মায়ের মুখ।

কান্তা জামিল রওশন জামিলের মেয়ে