‘আমি তো বেঁচে আছি, কখন বন্দুকযুদ্ধে মরলাম’

  • অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেবেন বাদী।

  • হত্যাচেষ্টার এ মামলা হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। গত বছরের ডিসেম্বরে

প্রতীকী ছবি

টিনের ছাউনির ঘরে দুপুরে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আবদুল জলিল। পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনে নিরাপত্তাপ্রহরীর কাজ করেন তিনি। ছেলে জয়নাল কোথায়, জিজ্ঞেস করতেই জলিল উত্তর দেন, ‘কিছুক্ষণ আগে ঘর থেকে বের হয়েছে। আশপাশে কোথাও হয়তো আছে।’ পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছেলে নাকি নিহত হয়েছে—এ প্রতিবেদকের কাছে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে জলিল বলেন, ‘চোখের সামনে জলজ্যান্ত ছেলে। কখন মারা গেল, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’

বলতে না বলতে গায়ে শার্ট জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন জলিল। এ প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে ছেলেকে খোঁজা শুরু করেন। জলিলের চোখেমুখে আতঙ্ক দেখে আশপাশের লোকজনও জড়ো হয়। কিছু দূর যেতেই একটি মাঠের কোনায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায় জয়নালকে। তাঁকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন জলিল।

নিজের ‘নিহত’ হওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে যান জয়নালও। বলেন, ‘আমি তো মরিনি। বেঁচে আছি। কখন বন্দুকযুদ্ধে মরলাম।’

মো. জয়নাল (২০) নামের এই তরুণকে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত দেখিয়ে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আমিন জুট মিল এলাকার আবদুল জলিলের ছেলে জয়নাল। গত ২৪ আগস্ট দুপুরে ওই এলাকার পাহাড়িকা আবাসিকের দক্ষিণ দিকের পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে পাওয়া যায় জলিল ও তাঁর ছেলে জয়নালকে।

শুরু থেকেই এ মামলাটি তদন্ত করেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দীপংকর চন্দ্র রায়। তদন্ত শেষে ছয়জনকে আসামি করে গত বছরের ডিসেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তিনি। এতে এজাহারে নাম থাকা আসামি জয়নালকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন তিনি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘জয়নাল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’

সম্প্রতি আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়।

অতিসম্প্রতি প্রায় একই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জে। গত ৪ জুলাই ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় জিডি ও মামলা হলে পুলিশ তিন আসামি—আবদুল্লাহ, রকিব ও খলিলকে গ্রেপ্তার করে। ওই আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ওই কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে তাঁরা লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। নিখোঁজের ৫১ দিন পর গত ২৩ আগস্ট ‘মৃত’ ওই মেয়েটি এলাকায় ফিরে আসে। গতকাল সোমবার ওই তিন আসামি আদালতকে জানিয়েছেন, পুলিশ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে ওই স্বীকারোক্তি আদায় করে।

নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলমের আদালতে গতকাল তাঁরা জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন জানান। সম্প্রতি এই ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে এ ঘটনায় জেলার পুলিশ সুপার পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিন আসামির পরিবারের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অভিযোগে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হত্যাচেষ্টা মামলার বাদী শাহ আলম ও জয়নালের বাসা একই পাড়ায়। বাদীর নাতনি ফারহানা আক্তারের বিয়ে হয় একই পাড়ার মো. নাসিমের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য ফারহানাকে নির্যাতন করা হলে এর জোর প্রতিবাদ করেন শাহ আলম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর নাসিম দলবল নিয়ে দা, কিরিচ নিয়ে হামলা চালান শাহ আলম ও তাঁর পরিবারের ওপর। এ ঘটনায় শাহ আলম বাদী হয়ে নাসিম, জয়নালসহ সাতজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সব আসামি পরে জামিনে মুক্ত হন।

জয়নাল প্রথম আলোকে বলেন, শাহ আলমের করা হত্যাচেষ্টা মামলায় তিনি কারাগারে ছিলেন। জামিনে এসে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষ্য, করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় এত দিন হাজিরা দেননি।

তদন্ত কর্মকর্তার এমন কাণ্ড শুনে অবাক জয়নালের আইনজীবী নুরজাহান ইসলামও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়নাল হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। মরল কখন?’ পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রটি তিনি দেখবেন বলে জানান।

মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার পর ফলাফল বাদীকে জানানোর বিধান থাকলেও এসআই দীপংকর তা জানাননি। ফলে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া ও আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে অন্ধকারে রয়ে গেছেন বাদী শাহ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জীবিত আসামিকে মৃত দেখিয়ে বাদ দেওয়ায় এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করবেন তিনি।

ঘটনার দিন জয়নালের দায়ের কোপে আহত হন মো. নীরব নামের এক ব্যক্তি।

এলাকায় গেলে তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ে কোপের দাগ দেখিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের সামনে লোক ঘুরছে। আর পুলিশ বলছে মারা গেছে।’ এটি কেন করা হলো তা তদন্ত হওয়া উচিত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই দীপংকর চন্দ্র রায় বর্তমানে নগরের খুলশী থানায় কর্মরত। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে। ঠিক করে দেব। রাইটার লিখতে ভুল করেছে।’ তদন্ত কর্মকর্তার যা লেখার কথা, থানার রাইটার তা লিখতে পারেন কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আর হবে না।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘এটি জঘন্য অপরাধ’
ঘটনাস্থলে না গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত করা দায়িত্ব হলেও তদন্ত কর্মকর্তা এটিকে দায়িত্ব মনে করেননি। উল্টো জীবিতকে মৃত বানিয়েছেন। এটি জঘন্য অপরাধ। তদন্ত কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাঁরা মামলাটি তদারকি করেছেন, সবারই গাফিলতি রয়েছে। পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি এবং দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করবেন।

এটিকে দায়িত্বে গাফিলতি হিসেবে উল্লেখ করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কেন এমন করেছেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিতে পারেন। তদন্ত করে পুলিশ কমিশনারও ব্যবস্থা নিতে পারেন।