আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য

‘তোমরা যখন শিখছো পড়া,

মানুষ হওয়ার জন্য,

আমি না হয় পাখিই হবো,

পাখির মতো বন্য’

পুরোনো কবিতার পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে কবি আল মাহমুদের ‘পাখির মতো’ কবিতার এই চারটি চরণ দেখে বেশ আঁতকে উঠলাম। আমরা মানুষ হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতায় আছি কিন্তু মানুষ হওয়ার অনেক পদ্ধতির মধ্যে শুধু পাঠ্যবই পড়াটাকেই বেছে নিয়েছি। ফলে কেন যেন দিন দিন আমরা বোকা বাক্সে বন্দী হয়ে যাচ্ছি। পাঠ্যবইয়ের এক গাদা পড়া মুখস্থ করে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেই চলছি, অন্যদিকে বাইরের দুনিয়াটা চেনার চোখগুলো দিন দিন কেন যেন ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে চলছে।

গত বছর দশম শ্রেণির শিশুর গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। বিকেলে শিশুর মা সবাইকে চিনাবাদাম ভাজা খেতে দিতেন। কৌতূহলবশত তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমরা চিনাবাদামগাছ দেখেছ? চিনাবাদাম মাটির ওপরে হয়, নাকি নিচে হয় বলো তো? শিশু দুটো অবশ্য উত্তর দিতে পারেনি। কেন যেন আমার ভেতর কোনো বিস্ময় এল না, কারণ গ্রাম থেকে উঠে আসা আমি ঢাকা শহরে আসার আগে জানতামই না ১০ টাকা কেজি আলু ঢাকায় এসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়ে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। আর ১৬-১৭ বছরের দুই ভাইবোন যারা কখনো গ্রামের মাঠে ময়দানে যায়নি, তারা কীভাবে জানবে চিনাবাদামেরগাছ কেমন?

ঢাকা শহরে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা হয়। কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হয় মেলাতে। চলতি বছর প্রায় ৮২ কোটি টাকার ও গত বছর সাড়ে ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। টাকার অঙ্কে হয়তো অনেক বড়। কিন্তু ঢাকা শহরের জনসংখ্যার দিকে তাকালে তা নিতান্তই কম। ঢাকাতে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসতি। ৫০ লাখ ছিন্নমূল মানুষ একদিকে রাখলে বই কেনা ও বই পড়ার সামর্থ্য আছে প্রায় দেড় কোটি মানুষের। এই হিসাব ধরলে একজন ঢাকাবাসী গড়ে বই কেনার পেছনে ব্যয় করেছে ৫০ টাকার কিছু বেশি। অথচ কারওয়ান বাজার থেকে নাবিস্কো মোড়ের ১০ মিনিটের রিকশা ভাড়াই ৬০ টাকা। আমাদের ভাবনার জগৎটা ঠিক এভাবেই ছোট হয়ে আসছে, যেটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত বৈ অন্য কিছু নয়।

‘আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবল শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড় আক্ষেপ করেই হয়তো কথাগুলো বলেছিলেন অথবা তিনি বাঙালির চরিত্র অনেক আগেই গোচর করতে পেরেছিলেন। লকডাউনের দিনগুলোতে অভ্যাস করা উচিত বই পড়ার। দিন শেষে যখন আমাদের শহরটা সুস্থ হয়ে উঠবে তখন যেন এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে আবার কাজে যোগ দিতে পারি, আমি এই বইগুলো পড়েছি। করোনার দিনগুলো একদিন শেষ হয়ে যাবে, তবে এই দিনগুলোতে বই পড়ে অর্জিত বোধোদয়, ভাবনার দুনিয়াটা কখনো শেষ হওয়ার মতো না। বই পড়া চলুক বছরব্যাপী, ভাবনার জগৎটা হোক যেন আকাশসমান।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা