আমের রাজ্যে মন্দা ভাব

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট আমের বাজার। ছবিটি গত শনিবার তোলা l প্রথম আলো
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট আমের বাজার। ছবিটি গত শনিবার তোলা l প্রথম আলো

আমের বাজারে যখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ও সুস্বাদু জাতের ক্ষীরশাপাতি ও ল্যাংড়ার আধিক্য থাকে, তখনই বুঝতে হবে এখন চলছে আমের ভরা মৌসুম। তবে এবার আমের উৎপাদন কম ও ভালো দাম না পাওয়ায় এই ভরা মৌসুমেও আমের রাজ্যের সবচেয়ে বড় এলাকা শিবগঞ্জের আমচাষি, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন ভালো নেই।

জেলার শিবগঞ্জের কানসাটে আমের সবচেয়ে বড় বাজার, আড়ত ও অস্থায়ীভাবে নির্মিত খাবার হোটেলগুলোতে ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেল।

গত শনিবার সকালে কানসাটে আমের বাজারে ঢুকতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের কানসাটের আমের আড়তগুলোর সামনে কোনো যানজটে পড়তে হয়নি। তবে কৃষি বিভাগ নির্মিত আমের বাজারে গিয়ে বোঝা যায়নি আমের স্বল্পতা। বিরাট এলাকাজুড়ে সারি সারি রিকশা, ভ্যান, ভটভটির ওপর বড় বড় ডালিভর্তি ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, বোম্বাই, লক্ষ্মণভোগসহ গুটিজাতের নানা রকমের হাজার হাজার মণ আম। শত শত ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে পা ফেলার স্থান নেই।

এ বাজারে কথা হয় আম বিক্রেতা শিবগঞ্জের শিবনগর গ্রামের আবদুল হাকিম, কানসাট শিবরামপুরের হাবিবুর রহমান, রঘুনাথপুরের নিজাম উদ্দীনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, কানসাটের আমের বাজারে ক্ষীরশাপাতি আম ১০-১২ দিন ধরে, আর ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে এক সপ্তাহ ধরে। মানভেদে ক্ষীরশাপাতি ২০০০ থেকে ২৮০০ টাকা, ল্যাংড়া ১৬০০ থেকে ২২০০ টাকা, লক্ষ্মণভোগ ১২০০ থেকে ১৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। লক্ষ্মণভোগের মতো দামে বিক্রি হচ্ছে বোম্বাই আমও।

কানসাট বাজারে মাইনুল ইসলামের আড়তে কথা হয় মাদারীপুরের আম ব্যবসায়ী এমদাদ হোসেনের (৫২) সঙ্গে। আম ব্যবসার সঙ্গে তিনি বহুদিন জড়িত। আম পাঠান ঢাকার বাদামতলীতে। তিনি জানান, আমের এই ভরা মৌসুমে তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ ক্যারেট (প্লাস্টিকের ঝুড়ি) আম পাঠাতেন। কিন্তু এবার পাঠাচ্ছেন ৩০-৪০ ঝুড়ি করে। বাজারে আমের আমদানি কম, দামও বেশি।

তবে আড়তদার মাইনুল ইসলাম বলেন, এবার আমও কম, দামও কম। দাম এই অর্থে কম যে বাগানের আম কেনা ব্যবসায়ীদের কাছে দাম পড়েছে অনেক বেশি। কেননা এ বছর উৎপাদিত হয়েছে গত বছরের তুলনায় কম। তার ওপর দুটি কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টিতে আমের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এতে বর্তমান বাজারে মূল্য তাঁদের কাছে কমই বলতে হবে।

কানসাট বাজারের বড় আড়তদারদের মধ্যে শফিকুল ইসলাম অন্যতম। গত বছর এই সময় প্রতিদিন চার-পাঁচ ট্রাক আম পাঠাতেন। এবার এক ট্রাক পাঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি জানান, আড়ত চালাতে নিয়োগ দিয়েছিলেন ৬৫ জন শ্রমিক। এখন কাজ করছেন অর্ধেকেরও কম। তাঁদের আয়ও হচ্ছে কম। কানসাটে এই সময় চার-পাঁচ শ আড়তে কাজ হয়। এখন চালু আছে মাত্র এক শর মতো। এ ছাড়া আমের দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, গত বছর এ সময় আমের দাম এর চেয়ে বেশি ছিল। উৎপাদনও ছিল বেশি। ব্যবসায়ীদের লাভ হয়েছিল ভালোই। এবার উৎপাদনও কম, দামও ভালো পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাই এই ভরা মৌসুমে মন ভালো নেই আম ব্যবসায়ীদের।

একই মন্তব্য করেন কানসাট বাজার আম আড়তদার সমন্বয় কমিটির সভাপতি আবু তালেব।

আমের মৌসুমে বাজারের আশপাশে বসে এক শর মতো অস্থায়ী খাবার হোটেল। ব্যবসায়িক মন্দা ভাব লক্ষ করা গেছে এসব হোটেলেও। শিবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের পাশে টিনের বেড়া ও টিনের চালা দিয়ে অস্থায়ী একটি হোটেল নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন জাহাঙ্গীর আলম। হোটেল সামলাতে অন্য বছর ১২ জন কর্মচারী নিয়োগ দিতেন তিনি। এবার রেখেছেন ছয়জন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘এই সময় আপনাদের সঙ্গে কথা বলার অবসরই পেতাম না। অথচ পুরো হোটেল এখন ফাঁকা। আগে প্রতিদিন ৩০-৪০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। এখন হচ্ছে সাত-আট হাজার টাকা।’

কথা হয় জেলা ট্রাক ও মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণাধীন কানসাট সড়ক পরিবহন শ্রমিক বিশ্রামাগারের সভাপতি বাইতুল মোকাদ্দেসের সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছর এই সময় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২৫ ট্রাক আম যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার যাচ্ছে ৩০ থেকে ৫০টি ট্রাক।

জেলায় ২৬ হাজার হেক্টর জমির আমবাগানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিবগঞ্জে। এবারের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় অর্ধেক—আম ব্যবসায়ী ও বাগানমালিকদের এমন ধারণা মানতে রাজি নন শিবগঞ্জের ইউএনও এস এম আমিনুজ্জামান। তিনি বলেন, দু-তিনটি ঝড়ে কয়েকটি ইউনিয়নের বাগানে আম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেশির ভাগ এলাকার ক্ষতি হয়নি। গত বছর আমের উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। এবার উৎপাদিত হবে ১ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন। ঝড়ে ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া আমের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ফজলি ও আশ্বিনা আমের তেমন ক্ষতি হয়নি। ক্ষীরশাপাতি ও ল্যাংড়া আমের উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।