আর ফেরা হলো না ওয়াসিমের

নিহত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওয়াসিম। ছবি: সংগৃহীত
নিহত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওয়াসিম। ছবি: সংগৃহীত

‘মা, আরও ১৫টা দিন। আমার থিসিস (গবেষণাপত্র) বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েই বাড়িতে ফিরব, আর তোমার হাতের মজার মজার রান্না খাব। হোস্টেলের খাবার আর ভালো লাগে না।’

এই ছিল ওয়াসিমের শেষ কথা। রোববার ছেলের লাশের পাশে কাঁদতে কাঁদতে এই কথাগুলো বলছিলেন তাঁর মা মিনা বেগম (৫৫)। দিশেহারা মিনা বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ওয়াসিমের সহপাঠীরা। কিন্তু কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না তাঁকে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর বাসস্টেশনে গতকাল শনিবার বিকেলে ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে বাস থেকে ঘোরি মো. ওয়াসিম আফনানকে গলাধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন চালকের সহকারী মাসুক আলী। এতে ঘটনাস্থলেই বাসের চাকার নিচে পড়ে মারা যান তিনি। ওয়াসিম সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

প্রশাসনিক অনুমোদন নিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ওয়াসিমের মরদেহ গতকাল শনিবার রাতে তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের রুদ্রগ্রামে নিয়ে আসা হয়। রাতভর আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা চলে বাড়িটিতে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের লাগোয়া ওয়াসিমদের বাড়ি। রোববার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায় হাজারো মানুষের সমাগম। সবাই নিহত ওয়াসিমকে একনজর দেখতে ভিড় করেছেন। সিলেট থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও আজ দুপুরে রুদ্রগ্রামে আসেন। এলাকার সাংসদ, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আজ ওয়াসিমের বাড়িতে যান। সবাই ওয়াসিমদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওয়াসিমের মা-বাবার কান্না থামছিল না কোনো কিছুতেই।

ওয়াসিমের মা মিনা বেগম নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন পরিদর্শক। তিনি ছেলের সহপাঠীদের অনেককেই চিনতেন। কিছুক্ষণ পরপর কারও কারও নাম ধরে ডেকে তিনি বলছিলেন, ‘তোমাদের সামনে আমার ছেলেটাকে মারল, কেউ কী বাঁচাতে পারলা না?’ এই প্রশ্নের জবাব ছিল না কারও কাছে।

ওয়াসিমেরা এক ভাই, এক বোন। ভাইবোনের মধ্য ছোট ছিলেন ওয়াসিম। বোন তাহুরা ইয়াসমিন ঘোরির বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেন।

ওয়াসিমের বাবা আবু জাহেদ মাহবুব ঘোরি ছিলেন পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির পরিদর্শক। সম্প্রতি তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। বারবার একটি কথাই বলছিলেন, ‘আমার সব শেষ, আমি আর কী নিয়ে বাঁচব?’ আবু জাহেদ বলেন, ‘আমার চোখের সামনে থেকে ছেলে আরও ১০ জন সহপাঠী নিয়ে বাসে উঠল। এ বাসই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে, তা কে জানত।’ বাস ছেড়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর দুর্ঘটনার খবর পান তিনি।

ওয়াসিমের মামা শামীম চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ভাগনে কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে গত শুক্রবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এক আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দেন তিনি। পরে গতকাল শনিবার বিকেলে ওয়াসিম তাঁর বাড়ির সামনে থেকে উদার বাসে উঠে। ওই বাসেই ঘটে সব ঘটনা।

রোববার বেলা ২টায় ঘোরি মো. ওয়াসিম আব্বাসের জানাজা রুদ্রগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। এতে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সাংসদ মো. শাহনওয়াজ মিলাদ গাজী, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীগঞ্জ-বাহুবল সার্কেল) পারভেজ আলম চৌধুরী, নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান, দেবপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদসহ হাজারো মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

আরও পড়ুন