আরও ১ লাখ লিটার জব্দ

মঙ্গল ও বুধবার ২০ জেলায় অভিযানে ১ লাখ লিটার জব্দ। তিন দিনে জব্দ ২ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৩ লিটার।

দোকানির বাড়ি থেকে সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার পাবনার সুজানগর উপজেলার সদর বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার ছয় দিন পরও বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। বড় বাজারের খুচরা দোকানগুলোতে কিছু বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা গেলেও পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে এখনো সংকট রয়েই গেছে। তবে বড় ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের গুদামগুলোতে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার লিটার তেল উদ্ধার করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

গতকাল বুধবার ও আগের দিন মঙ্গলবার—এ দুই দিনে ২০ জেলায় অভিযান চালিয়ে আরও ১ লাখ ১১ হাজার ১৬৭ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়েছে। এ সময় বেশি দামে তেল বিক্রি ও মজুত করার দায়ে ব্যবসায়ীদের ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার সাত জেলায় অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়। এ সময় ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ নিয়ে গত তিন দিনের অভিযানে ২ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৩ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হলো। এর মধ্যে বেশির ভাগ তেল সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

জেলায় জেলায় অভিযান, জরিমানা

গতকাল বড় অভিযানটি চালানো হয় পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়ায়। এ দুই উপজেলায় তিন তেল ব্যবসায়ীর গুদামে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ৬০ হাজার ৩০০ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে। বেলা তিনটার দিকে গোয়েন্দা পুলিশ প্রথমে বেড়ার কাশিনাথপুর বাজারের ব্যবসায়ী সুনীল সাহা ওরফে ব্যাংক সুনীল এবং লক্ষ্মণ সেনের গুদাম থেকে ৩০ হাজার ৩০০ লিটার বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল উদ্ধার করে। পরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে একই বাজারের সাঁথিয়া উপজেলার অংশে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ মীর স্টোরের মালিক মীর মো. আবুল খায়েরের গুদাম থেকে আরও ৩০ হাজার লিটার মজুত করা সয়াবিন তেল উদ্ধার করে এবং আবুল খায়েরকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

পরে বেড়ার ইউএনও মোহা. সবুর আলী ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে অবৈধভাবে তেল মজুত করার অপরাধে সুনীল সাহাকে দুই লাখ এবং লক্ষ্মণ সেনকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেন। একই সঙ্গে আদালত দুই দিনের মধ্যে উদ্ধার করা তেল আমিনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে সরকার নির্ধারিত দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রির নির্দেশ দেন।

এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে ঝালকাঠিতে একটি গুদাম থেকে ১৩ হাজার ৭৪৬ লিটার তেল জব্দ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। শহরের মনিহারিপট্টি এলাকায় ব্যবসায়ী গৌতম হালদারের গুদাম থেকে ওই তেল উদ্ধার করা হয়। ঝালকাঠি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইন্দ্রাণী দাস বলেন, অবৈধভাবে তেল মজুত করার দায়ে ব্যবসায়ী গৌতম হালদারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তাঁর গুদাম থেকে ১৬ কেজির ৮০০ টিন, পাঁচ লিটারের ৩৪ বোতল, ১৬ লিটারের ৪৮টি কনটেইনার এবং ৫০০ গ্রামের ১৬টি বোতল উদ্ধার করা হয়। পরে তেল নিতে আসা সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার নির্ধারিত আগের দামে এসব তেল বিক্রি করা হয়।

গতকাল বাগেরহাট শহরের তেলপট্টি ও নাগের বাজারের তিনটি দোকান এবং গুদামে অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার ২০০ লিটার তেল উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৭৩০ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ছিল। পরে ওই তেল আগের দামে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। এ সময় তেল কিনতে কয়েক শ মানুষ ভিড় করেন। এ সময় অবৈধভাবে ভোজ্যতেল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির দায়ে তিন ব্যবসায়ীকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মজুত করা তেল উদ্ধারে সবচেয়ে বড় অভিযানটি চালানো হয়েছিল মঙ্গলবার রাজশাহীর বানেশ্বরে। ওই দিন বিকেলে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজারের চারটি গুদাম ও একটি ট্রাক থেকে ৯২ হাজার ৬১৬ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়।

ছয় দিনেও সংকট কাটেনি

রাজধানীর বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বিক্রেতারা বলছেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে শুধু পুষ্টি আর তীর কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। রূপচাঁদা আর বসুন্ধরা কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা এখনো অর্ডার নিচ্ছেন না। ওই দুই কোম্পানির তেল বিভিন্ন বাজারের দোকানগুলোতে দেখা যায়নি।

গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর জাফরাবাদ, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও জিগাতলা এলাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের বেশির ভাগ দোকানে সয়াবিন তেল আছে। কোনো দোকানি শুধু দুই ও পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি করছেন। কোনো কোনো দোকানে আবার আধা লিটার থেকে শুরু করে এক ও দুই লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে।

রায়েরবাজারের মেসার্স হোসেন স্টোরে পুষ্টির আধা লিটার, এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছিল। বিক্রেতা রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুষ্টির সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। তবে অন্য কোনো কোম্পানির তেল বাজারে না থাকায় সংকট পুরোপুরি কাটেনি। নতুন দামের তেলের সঙ্গে পণ্য গছিয়ে দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘তিন কার্টন তেলের সঙ্গে আমাকে আটা ২৪ কেজি, শর্ষের তেল ১২ বোতল (২৫০ গ্রাম ওজনের) এবং ২০০ গ্রাম ওজনের পুষ্টি চা ২৪ প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। আমি এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবেশক বলেছেন, ওই পণ্যগুলো না নিলে আমাকে তেল দেওয়া হবে না।’

তবে রায়েরবাজারের কিছু কিছু দোকানের মালিক তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। সয়াবিন তেল বিক্রি না করার কারণ হিসেবে ওই দোকানিরা জানান, কোম্পানির পরিবেশকেরা নতুন দামের সয়াবিন তেলের সঙ্গে কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য গছিয়ে দিচ্ছেন। যে কারণে ওই সব অচল পণ্য আর বিক্রি হয় না। তখন তেল বেচতে পারলেও কোনো লাভই হয় না।

রায়েরবাজার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরেই খান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি মুদিদোকান। প্রায় এক মাস ধরে দোকানটিতে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ আছে বলে জানালেন মালিক কে এম আশরাফুল ইসলাম। ক্রেতাদের স্বার্থে তিনি খোলা সয়াবিন ও পাম সুপার বিক্রি করছেন বলেও জানান।

ওই দোকানে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ২০৫ ও পাম সুপার ১৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৮০ এবং পাম সুপারের দাম ১৭২ টাকা। এ ছাড়া জাফরাবাদ, হাজারীবাগ, জিগাতলা, ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকার পাড়া–মহল্লার দোকানেও বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা যায়নি।


[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]