আর্থিক ক্ষতি মেনেই সাঙ্গ হলো বইমেলা

বইমেলার শেষ দিন স্টল থেকে বই নামিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। আজ সোহরাওয়াদী উদ্যানে
ছবি: প্রথম আলো

মেয়াদের দুদিন আগেই শেষ হলো এবারের বাংলা একাডেমির অমর একুশের বইমেলা। প্রাণের মেলা বলে খ্যাত এই মেলাকে এবার প্রকাশকেরাই অভিহিত করলেন ‘মন খারাপের মেলা’ বলে। আজ মেলার শেষ দিনে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, বিপুল অঙ্কের ক্ষতির কবলে পড়েছে তারা। এবার মেলায় বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।

আগেই একাডেমির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ১৪ এপ্রিলের বদলে ১২ এপ্রিল শেষ হবে মেলা। শেষ দিনে নির্ধারিত সময়ের পরও মেলার মাঠে অনেক মানুষ দেখা গেল। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মেলার সময় থাকলেও দুপুর থেকেই তাক থেকে বই নামিয়ে বাঁধাছাদা করতে দেখা গেল স্টলের কর্মীদের। বিকেল চারটা থেকে রীতিমতো স্টল–প্যাভেলিয়ন ভাঙার কাজ শুরু হয়ে যায়।

কলি প্রকাশনীর প্রকাশক মহিউদ্দিন কলি বললেন, একাডেমি থেকে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই বইপুস্তক সব সরিয়ে নিতে হবে। রাতে কোনো পাহারা থাকবে না। প্রতিবছর সাধারণত শেষ দিনের রাতেও পাহারার ব্যবস্থা থাকত। সন্ধ্যার আগেই বাঁধাছাদা না করতে পারলে, ভ্যান পাওয়া কঠিন হবে। তখন বইগুলো সরিয়ে নিতে সমস্যা হবে। এমনিতেই বেচাকেনা নেই। শুধু শুধু অপেক্ষা না করে সবাই দ্রুত স্টল খালি করতে চাইছেন।

‘লেখক বলছি’ মঞ্চে লেখকদের উপস্থিতি বন্ধ হয়েছিল গত ৩১ মার্চেই। শেষ দিনের বিকেলে সেই শূন্য মঞ্চে সংবাদ সম্মেলন করলেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নেতারা। মেলাকে তাঁরা বললেন ‘মন খারাপের মেলা’। লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সহসভাপতি এবং বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক শ্যামল পাল বললেন, এবার মেলায় তাঁদের হিসাবে বিক্রি হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৯২৮ টাকার বই। গত বছর বাংলা একাডেমির হিসাবে বই বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা। এ থেকেই এবারের মেলার অবস্থা বোঝা যাবে।

প্রকাশক নেতারা বললেন, এবারের মেলায় ৪১৩টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এক ইউনিটের স্টলের ভাড়া, নির্মাণ ও পরিচালনার অনুৎপাদন খাতে সারা মাসে খরচ হয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা। এ ছাড়া বই প্রকাশের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। যাঁরা দুই, তিন ও চার ইউনিটের স্টল এবং প্যাভেলিয়ন পেয়েছেন, তাঁদের খরচ আনুপাতিক হারে অনেক বেশি। সব মিলিয়ে প্রকাশকেরা প্রায় এক শ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন। মেলা থেকে তাঁদের এই বিনিয়োগের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উঠে আসে এবং বাদবাকি টাকা সারা বছরের বিক্রি থেকে আসে। এবার মেলায় বিক্রি একেবার তলানিতে ঠেকেছে। আর করোনার কারণে মেলার পরও বিক্রি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গত বছরের মেলার পর থেকেই সৃজনশীল বইয়ের বিক্রি কমে গেছে। তাঁরা আশা করছিলেন, এবারের মেলায় কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি।

শেষ দিনে বইমেলা প্রাঙ্গণে কিছু ক্রেতা সমাগম
ছবি: প্রথম আলো

মেলার বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে তাঁরা ফেব্রুয়ারির বদলে চৈত্র মাসের খররোদের সময় মেলা করা এবং বারবার সময় পরিবর্তন করাকে দায়ী করেছেন। এ ছাড়া স্টল বিন্যাসেরও সমালোচনা করে তাঁরা বলেন, মূল মাঠে প্যাভেলিয়নগুলো একসঙ্গে রেখে ছোট প্রকাশকদের স্টলগুলো দূরে ঠেলে দেওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে ক্রেতাদের উপস্থিতি খুবই কম ছিল। স্টল ও প্যাভেলিয়ন মিলেমিশে সারা মাঠে ছড়িয়ে দিলে সবাই ক্রেতা পেতে পারতেন।

প্রকাশকেরা তাঁদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, নগদ আর্থিক সহায়তা তাঁরা চান না। এর বদলে সরকার যদি ১০০ কোটি টাকার বই কেনার জন্য বিশেষ বাজেট করে এই ৪১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে মানসম্মত বই কেনে, তবে প্রত্যেকেই তাঁদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। এর পাশাপাশি তাঁরা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানেরও আবেদন জানান।

সেরা স্টল

এবার বাংলা একাডেমি মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি। সমাপনী অনুষ্ঠানে সাধারণত সেরা বই ও সাজসজ্জায় সেরা স্টলের জন্য ‘কাইয়ুম চৌধুরী পুরস্কার’ দেওয়া হয়। এবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেরা স্টলের পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্যাভেলিয়নে সেরা পুরস্কার পেয়েছে কথাপ্রকাশ, দুই ইউনিটের স্টলের জন্য সংবেদ এবং এক ইউনিটের স্টলের জন্য পুরস্কার পেয়েছে উড়কি।

বইমেলার শেষ দিন স্টল থেকে বই নামিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। আজ সোহরাওয়াদী উদ্যানে
ছবি: প্রথম আলো

মোট বই ২৬৪০টি

এবার মেলায় মোট নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪০টি। এর মধ্যে কবিতা ৮৯৮টি, উপন্যাস ৪০৫টি, গল্প ৩৩৯টি, প্রবন্ধ ১৫৮টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ৮২টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৫৫টি, ছড়া ৫২টি, বিজ্ঞানবিষয়ক বই প্রকাশিত হয়েছ ৪২টি। আজ শেষ দিনে নতুন বই এসেছে ৬৪টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে—মাওলা ব্রাদার্স এনেছে শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ ‘সংস্কৃতি রাজনীতি ও নব-বাস্তবতা’, অন্য প্রকাশ এনেছে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘বধ্যভূমিতে বসন্তবাতাস’, চন্দ্রবিন্দু এনেছে ফেরদৌস রহমানে কাব্য ‘তুমি অন্য কারো ছাতিম ফুল’, সদর প্রকাশনী এনেছে আতিউর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু সহজতর পাঠ’, আগামী এনেছে ড. মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসীর ‘১৯৭১ তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না’, পানকৌড়ি এনেছে সাইম রানার কাব্য ‘অনুধাবনের কাল’, মাসুদ পথিকের কাব্য ‘পাগলের বুদবুদ’।