আলো ছড়ানো প্রবীণ

১৯৫৭ সালে লন্ডনে আসা দবিরুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, শিকড়হীন মানুষের প্রকৃত পরিচয় থাকে না
ছবি: লেখক

আগেই ঠিক করা ছিল ১৮ অক্টোবর দুপুর পৌনে ১২টায় তাঁর পূর্ব লন্ডনের বাসায় দেখা করব। তবে বাসা পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল না। দেখি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছেন মোহাম্মদ দবিরুল ইসলাম চৌধুরী। পরিচয় দিতেই বললেন, ‘আতিক বলেছে আপনি আসবেন। চলুন, আমাদের বাগানে গিয়ে বসে কথা বলি।’ তাঁর উৎসাহ দেখে কে বলবে এই লোকটা ১০২ বছর অতিক্রম করছেন!

হঠাৎ কেন বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে অভিবাসী হওয়া শতবর্ষী এই বৃদ্ধকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তা বলার সূত্রেই চোখ ফেরানো যাক এক বছর আগে।

করোনার ভয়াল থাবায় তখন থমকে আছে বিশ্ব। ঘরবন্দী মানুষ। চারদিকে মৃত্যু আর হাহাকারের মিছিল। ২০২০ সালের সেই ঘোর করোনাঘেরা সময়ে, এপ্রিল মাসে লন্ডনের নিজ ঘর ছেড়ে বের হলেন এক শ পেরোনো দবিরুল ইসলাম চৌধুরী। ঘোষণা করলেন, রমজান মাসের পুরোটা সময় তিনি নিজের বাড়ির বাগানে প্রতিদিন ১০০ কদম করে হাঁটবেন। উদ্দেশ্য যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশে করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত মানুষের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা।

যেই কথা সেই কাজ। রোজা রেখে প্রতিদিন প্রায় ৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের নিজ বাড়ির বাগানে দবিরুল ইসলাম চক্কর দিয়েছেন ৯৭০ বার। প্রতি চক্করে এক শ কদম করে হেঁটেছেন ৮০ মিটারের বেশি। গেল বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে তিনি শুরু করেন এই কাজ। প্রথমে দবিরুল ইসলামের নাতি তহবিল সংগ্রহের ওয়েবসাইট জাস্ট গিভিংয়ে এই উদ্যোগ নিয়ে একটি পোস্ট দেন। বন্ধু-আত্মীয়রা শেয়ার করেন সেই লিংক।

এর পরের গল্প অন্য রকম। গার্ডিয়ানসহ অন্যান্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শতবর্ষীর এই উদ্যোগের খবর।

মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে শুরুতে তাঁর ভাবনা ছিল, ৫০-৬০ কদম হেঁটে বড়জোর ১ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করবেন। কিন্তু মাত্র ছয় ঘণ্টাতেই আসে হাজার পাউন্ডের বেশি। শেষ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ কোটি) সংগ্রহ করেন তিনি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএসকে দেওয়া হয় ১ লাখ ১৬ হাজার পাউন্ড। বাকি অর্থ বণ্টন করা হয় ৫২টি দেশের ৩০টি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।

দবিরুল ইসলাম এই কাজের প্রেরণাটি পেয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন টম মুরের কাছ থেকে। করোনার সময় এই ক্যাপ্টেন নিজের বসতবাটির বাগানে হেঁটে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি পাউন্ড তুলেছেন। ‘আমি সব সময় দাপিয়ে বেড়ানো লোক। ঘরে থাকা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব। কিন্তু করোনায় যখন সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলো, আমার জন্য সেটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। পরে টিভিতে টিম মুরের কর্মকাণ্ড দেখে উৎসাহিত হয়ে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়ি।’ দবিরুল ইসলাম চৌধুরী বলছিলেন।

তাঁর গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু করোনাকালে মানবসেবার মহতী উদ্যোগের পাশাপাশি ব্রিটিশ সমাজে নিজেকে সাহস আর অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে মর্যাদাপূর্ণ একটা স্বীকৃতি পেয়েছেন এই অভিবাসী বাংলাদেশি। যুক্তরাজ্যের রানি তাঁকে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (ওবিই) খেতাব দিয়েছেন। রানি এলিজাবেথের জন্মদিন উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের সমাজজীবনে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা রাখেন, প্রতিবছর তাঁদের খেতাব দিয়ে সম্মান জানানোর রীতি আছে। এ বছরের জুনে এই সম্মাননা ঘোষণা করা হয়। আর দবিরুল ইসলাম চৌধুরী বাকিংহাম রাজপ্রসাদে সম্মাননা গ্রহণ করতে যান ১৪ জুলাই। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ পাওয়ার ঘটনা হাতে গোনা। যে বয়সপর্যন্ত মানুষের বেঁচে থাকাটাই বিরল ব্যাপার, সেই বয়সে তারুণ্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ১০২ বছরের দবিরুল ইসলাম।

মোহাম্মদ দবিরুল

ইসলাম চৌধুরী

অভিবাসী প্রবীণ বাংলাদেশি

জন্ম

জানুয়ারি ১৯২০, দিরাই, সুনামগঞ্জ

পড়াশোনা

মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা, সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে মাধ্যমিক, সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, পরে লন্ডনের কিংস কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে

পড়ালেখা করেছেন

ইংল্যান্ডে গমন

১৯৫৭ সাল

পেশা

প্রথম জীবনে চাকরি, পরে ব্যবসা; এখন অবসর যাপন করছেন

অর্জন

ব্রিটিশ রানির সম্মাননা ‘অর্ডার অব

দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’

আমরা আবার আলাপ শুরু করলাম তাঁর সঙ্গে। আলাপের শুরুতে যে আতিকের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেই আতিক তাঁর একমাত্র ছেলে। পুরো নাম আতিক চৌধুরী। দবিরুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষ্যে, ‘আতিক আমার পার্টনার। ও যেখানে যাবে তাঁর সঙ্গে আমি আছি।’ খানিক বাদে আমাদের আলাপে সঙ্গ দেন আতিকও। তিনি বলেন বাকিংহামে তাঁর বাবার সম্মাননা নিতে যাওয়ার গল্প। ‘সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সবার চোখ ছিল বাবার দিকে। কারণ, সম্মাননা গ্রহণ করতে যাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক তিনি। প্রিন্স চার্লস তাই বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বাবার প্রতি। তাঁর বয়স ১০২ পার হয়েছে শুনে প্রিন্স চার্লস এই দীর্ঘ আয়ুর রহস্য জানতে চাইলেন।

তখন বাবার তরফ থেকে আমি তাঁকে বললাম, ‘রহস্য বেশি কিছু নয়, বাংলাদেশি খাবার আর কর্মময় জীবন।’

দবিরুল ইসলামের পাশে বসেই কথা বলছিলেন আতিক। আর ছেলের কথায় সায় দিচ্ছিলেন বাবা। আতিক পুনরায় বললেন, ‘বাবার জন্ম বাংলাদেশে শুনে সেদিন চার্লস বলেছিলেন, “ওহ আপনি বাংলাদেশের। আমার তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, করোনা মহামারির কারণে যাওয়া হলো না।” তখন আমরা তাঁকে বলেছিলাম, “চিন্তার কিছু নেই। যেকোনো সময়েই বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত।” এবার প্রিন্স চার্লস বেশ জোর গলায় জবাব দিলেন, “ইনশা আল্লাহ।”’

বাংলাদেশ থেকে দবিরুল ইসলাম চৌধুরী লন্ডনে এসেছিলেন ১৯৫৭ সালে। ১৯৭১–এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাঙালিদের সোচ্চার করতে এবং দেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে যুক্তরাজ্যের শহরে শহরে চষে বেড়িয়েছেন।

অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, নিজের শিকড় ভুলে যেতে নেই। তাই আলাপের শেষ পর্যায়ে বললেন, ‘জীবনে যেখানে যান, যত বড় কিছুই করেন না কেন নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সঙ্গে রাখুন। শিকড়হীন মানুষের প্রকৃত কোনো পরিচয় থাকে না।’

  • তবারুকুল ইসলাম: প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি