‘আহা, আগুনের আলোও এত সুন্দর!’

‘আকাশপথের মুক্তিসেনা’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে কথা বলছেন কিলো ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক। তাঁর বাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, আর ডানে কিলো ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তম এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব সারা যাকের
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

হামলা পরিচালনার জন্য বিমান নিয়ে নিচের দিকে নামছিলেন। একপর্যায়ে বিমানটি ছিল ভূমি থেকে মাত্র ৫০ ফুট ওপরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে লক্ষ্যবস্তু চট্টগ্রামের বার্মা ইস্টার্নের তেলের ডিপোতে বিমান থেকে এক জোড়া বোমা ছুড়লেন। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটল না। দ্বিতীয় জোড়া বোমাও বিস্ফোরিত হলো না। লক্ষ্য ব্যর্থ। সেই সঙ্গে বিপদ আরও বাড়ল। তথ্য ছিল—ডিপো থেকে বিমানের দিকে গুলিবর্ষণের (অ্যান্টি–এয়ারক্রাফট গান) ব্যবস্থা নেই। কিন্তু বৃষ্টির মতো গুলি আসতে লাগল। আর ঠিক সেই সময়ে তৃতীয় জোড়া বোমাটি সফলভাবে আঘাত হানতে পারল। অন্ধকার চিরে আলোর ঝলকানিতে চারপাশ দিনের আলোর মতো হয়ে যায়। সেই ঝলকানিতে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন বিমানে থাকা তরুণেরা। আহা, আগুনের আলোও এত সুন্দর! আরেক প্রান্ত নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপোতে ঠিক একই সময়ে চলেছে আরেকটি হামলা। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর এ দুটি হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

একটি স্বাধীন মানচিত্রের জন্য জীবন বাজি রেখে করা প্রথম বিমান হামলা সফলভাবে শেষ করলেন ‘কিলো ফাইটাস’রা। একাত্তরের নায়কদের মুখে গল্পগুলো রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল স্কুলের উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। চোখের সামনে যেন তারা দেখতে পাচ্ছিল সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযান। তাই মুহুর্মুহু হাততালি দিয়ে তারা নায়কদের অভিবাদন জানাচ্ছিল।

‘আকাশপথের মুক্তিসেনা’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। মঞ্চে (বাঁ থেকে) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব সারা যাকের, কিলো ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তম ও ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক
ছবি: প্রথম আলো

‘আকাশপথের মুক্তিসেনা’ শিরোনামে আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে কিলো ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তম এবং ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীকের কাছ থেকে একাত্তরের বীরত্বগাথা শুনছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও আগারগাঁও আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

কিলো ফ্লাইট গঠনের গল্প

১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কিলো ফ্লাইট গঠনের মাধ্যমে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। একাত্তরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম এবং প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে আলোচনা করতে কলকাতায় আসেন। ততদিনে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসে (পিআইএ) কর্মরত বাঙালি বৈমানিক ও কর্মকর্তাদের অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিমানবাহিনী গঠনে ভারতের সহযোগিতা চাইলে ভারত অপরাগতা প্রকাশ করে। ওই সময় ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লাল (পি সি লাল) যোধপুরের মহারাজার ডিসি–৩ (ডাকোটা) বিমানটি সংগ্রহ করে দিলেন। পরে আরও যুক্ত হয় ডিএইচসি (অটার) ও অ্যালুয়েট–৩ নামের একটি হেলিকপ্টার। সেগুলো রাখা হয় ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে। বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে। তাঁর নামের আদ্যাক্ষর ‘কে’ দিয়ে বাহিনীর নামকরণ হলো কিলো ফ্লাইট। আর ওই ফ্লাইটের যোদ্ধারা পরিচিত হলেন কিলো ফাইটাস৴ হিসেবে। এ কে খন্দকার বীর উত্তম ছাড়াও সেই বাহিনীতে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম বীর উত্তম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক, ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত বীর প্রতীক, ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক বীর প্রতীক, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তম এবং ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম। শেষের তিনজন এখন বেঁচে নেই।

শিক্ষার্থীরা শুনল গর্বের ইতিহাস

পাকিস্তানি বাহিনীর স্থাপনায় প্রথম বিমান হামলায় ব্যবহৃত অ্যালুয়েট–৩ হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন কিলো ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর উত্তম
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

নারায়ণগঞ্জে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে হামলা চালান স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। অটার বিমান নিয়ে চট্টগ্রামে হামলা পরিচালনা করেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ। শামসুল আলম বলেন, ‘অটারের উইংসের নিচে দুটি রকেট র‌্যাকে ১৪টি রকেট বোমা রাখা ছিল। তৃতীয় বোমা জোড়া সফল হলে নিচে তাকিয়ে দেখলাম কী সুন্দর আলো! আমরা চিৎকার করে বলেছিলাম জয় বাংলা।’ ওই দুটি হামলার জন্য আটকে ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধের ঘোষণা। তিনি বলেন, ‘৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় জনসমাবেশে থাকার সময় খবর পান ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা করেছে পাকিস্তান। হামলাটি বাংলাদেশের মুক্তিসেনারা আগে করুক চেয়েছিল ভারত। রাত ১২টা ১ মিনিটে আমরা হামলা চালানোর ২৪ মিনিট পর ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ড করা যুদ্ধের ঘোষণা প্রচার করা হয় রেডিওতে।’

অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার বলেন, তিনটি বিমানের কোনোটিই যুদ্ধবিমান ছিল না। ধীরগতির ছিল। যুদ্ধের সময়ে নিষ্প্রদীপ রাখা হয় চারপাশ, যাতে হামলা করার সময় শনাক্ত করা না যায়। বিমান ল্যান্ড করার জন্য নিচে থেকে কেউ একজন টর্চলাইট দিয়ে সংকেত দিত। জীবন নিয়ে ফিরে আসার কোনো নিরাপত্তা ছিল না। তবে এভাবে মারা যাওয়াও মর্যাদার।

স্বাগত বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, হামলাটি ছিল অসম এক লড়াই। প্রশিক্ষিত ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনটি বেসামরিক বিমান নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা হয়। তেলের ডিপোতে হামলার পর জ্বালানি সংকটে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর তাদের বিমান উড্ডয়নে অক্ষম হয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল হোঁচট খায়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব সারা যাকের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এসব বীরগাথা বার বার উঠে আসা উচিত তরুণ প্রজন্মের সামনে। একটি স্বাধীন দেশের জন্য বাঙালিদের তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ব্যবস্থাপক (কর্মসূচি) রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে কিলো ফাইটারদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। শেষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত দুটি বিমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘুরে দেখেন একাত্তরের নায়কেরা।