আয়হীন ক্ষুধার্ত মানুষের বাজেট চাই

করোনাভাইারাস নামক দানবে বিশ্ব আজ কম্পমান। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন—সবকিছুই আজ করোনাভারে জর্জরিত। করোনাভাইরাসের বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির সব খাত ঠিক হতে কতটা সময় লাগবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এর মধ্যেই বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। শতাংশ হিসাবে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। বাজেটে ঘাটতি সাধারণত ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। করোনার প্রভাবে প্রথমবারের মতো তা ৬ শতাংশ স্পর্শ করছে। বাজেটপূর্ব বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদেরা রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বললেও অর্থমন্ত্রী তাতে কান দেননি। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা
সরকার এবার এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাজেট তৈরি করেছে। করোনার আঘাতে পুরো বিশ্বে অর্থব্যবস্থায় ভয়ংকর মন্দার ঢেউ। গত তিন মাসে লাখো মানুষ আয়শূন্য হয়েছেন। এদের আয়ের পথে ফিরিয়ে আনা ও জীবন চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে চার কোটি দরিদ্র মানুষ আছেন। অতিদরিদ্র দেড় থেকে দুই কোটি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট থেকে ৩ ডলার ৮০ সেন্টের মধ্যে আয় করা কর্মজীবী মানুষ ৫৫ শতাংশ। তারা এখন ঝুঁকির মধ্যে আছেন। তাদের অনেকেই নতুনভাবে গরিব হয়েছেন, অনেকেই গরিব হওয়ার আশঙ্কায় আছেন। এই মানুষগুলোর সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন। এ ছাড়া দ্রুত নজর দিতে হবে কর্মহীন, আয়হীন ও ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি। যাদের সাহায্য প্রয়োজন, তারা বাদ পড়ে যায়, আবার যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের নাম স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তালিকায় ওঠে। এ জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সুবিধাভোগীদের তালিকাভুক্ত করা জরুরি। হতদরিদ্রদের তালিকা প্রস্তুত এবং অর্থ পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তদারকি ব্যবস্থায় স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সংশ্লিষ্ট করা যেতে পারে। সদিচ্ছা থাকলে ভাতা নিয়ে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন নয়।
স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র
স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানুষের জীবনজীবিকা ও উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের জবুথবু অবস্থা। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম। এমন একটা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাত্রা কল্পনাবিলাস মাত্র! বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার দায়বদ্ধতার জায়গাটি যে কতটা দুর্বল, করোনা সংকট মোকাবিলার সময় তা স্পষ্ট হয়েছে। দেশে বড় বড় অভিজাত হাসপাতাল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দুর্যোগে এগুলো আশানুরূপ সেবা দিতে পারেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট জিডিপির ৩ শতাংশ এবং বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা জরুরি বলে অর্থনীতিবিদেরা জানিয়েছেন। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এখনই সময়।
প্রণোদনা বাস্তবায়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা যেন রাজনৈতিক, দলীয় ও প্রভাবশালীদের পকেটে না যায়। বরাবরই যে পাওয়ার কথা, সে পায় না। যার পাওয়ার কথা নয়, তারা পেয়ে যায়। এ ছাড়া ঘোষিত প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্প খাতে ঋণ বরাদ্দ ঠিকই থাকবে। কিন্তু তারা ঋণ পাবে কি? দেশে একটি আদর্শ ঋণব্যবস্থা তৈরি হওয়া চাই। ঋণ বিতরণে ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমঝোতার ব্যবস্থা তৈরি হয়ে আছে। এ জন্য প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কারণ, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে অর্থনৈতিক সংকট হ্রাস-বৃদ্ধি।
নতুন কর্মসংস্থান তৈরি
করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। রোজগারের উৎসগুলো সংকুচিত বা বন্ধ হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, মধ্যবিত্তও এখন নানা সংকটে। যারা এখন কর্মে আছে, তাদেরও কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য ছোট ছোট, স্বল্পমেয়াদি এবং দ্রুত ফল পাওয়া যায়—এমন প্রকল্পে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মানুষ দ্রুত এর সুফল পাবে। অর্থনীতিতে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমেই শুধু বেকারত্ব সমস্যা দূর করা সম্ভব। এ জন্য উৎপাদনশীল খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। লোকদেখানো কিছু করলে এর সুফল পাওয়া যাবে না।
নজর দিতে হবে ব্যাংকিং খাতে
প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। অনিয়ম, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংকে। এ খাতকে উদ্ধার করতে দ্রুত অ্যাকশন প্ল্যান দরকার। প্রণোদনা পুরোটাই বলতে গেলে ব্যাংকনির্ভর। কিন্তু ব্যাংকের সে সক্ষমতা আছে কি? তারা ঋণ দিতে চাইছে না আদায় না হওয়ার কারণে। ব্যাংকগুলোকে ক্রিয়াশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার। লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলছে সরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে আগে অনেক বেশি টাকা নিত সরকার, আর এখন দরকারি টাকাই নিতে পারছে না। এটা অব্যবস্থাপনা।
অবহেলা নয় কৃষিকে
সরকার এই দুঃসময়ে কৃষিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে, যা প্রশংসাযোগ্য। তবে কৃষি ও শিল্প খাতে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধার দাবি রাখে। কৃষককে বীজ, সার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাত করা এবং ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা না পেলে কৃষক ফসল ফলানোয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। কৃষকদের সহজে কৃষিঋণ ও ন্যায্যমূল্যের ব্যবস্থা দেশে এখনো সম্ভব হয়নি। সংরক্ষণাগার না থাকায় মৌসুমে অনেক কম দামে কৃষককে ফসল বিক্রি করতে হয়। তাই উপজেলা পর্যায়ে কম হলেও একটি করে বড় পরিসরে ফসল সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা প্রয়োজন। গত এক যুগ ধরে সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ২২ লাখ টনেই আটকে আছে। খাদ্যনিরাপত্তার সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সংকটের দিকে যেতে পারে। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এটিকে আরও নামিয়ে আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে এটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রকৃত কৃষকেরা এই ঋণের সুবিধা পান।
রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ
বাজেটে বড় ধরনের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে যেন সাধারণ জনগণ নিষ্পেষিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যেন কোনোভাবেই বৃদ্ধি না পায়, বাজেট প্রণয়নে নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়টি বিবেচনা করবেন—এটাই সবার প্রত্যাশা। এ কথা ঠিক, এ বছর এবং আগামী অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অনেক কমে যাবে। ফলে বাজেটের অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য শিগগিরই স্বাভাবিক হবে না, এটা বোঝা যাচ্ছে। এ ছাড়া করোনার কারণে আগামী অর্থবছরে এমনিতেই নানা ধরনের কর ছাড় দিতে হবে। তাই রাজস্ব ঘাটতি সীমিত রাখতে কর ফাঁকি প্রতিরোধে বেশি মনোযোগী হতে হবে। রাজস্ব আহরণের গতিবৃদ্ধির জন্য জরুরিভিত্তিতে রাজস্ব প্রশাসনের প্রয়োজনীয় বিস্তৃতি ও আধুনিকায়নের যে পদক্ষেপ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতিমধ্যে নিয়েছে, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কর, ভ্যাট ও শুল্ক প্রশাসনে আধুনিকায়ন তথা সফটওয়্যার ও মেশিনের ব্যবহার এবং করদাতা ও ব্যবসায়ীদের বাধ্যতামূলকভাবে এসবের আওতায় আনতে পারলে রাজস্ব আহরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও খরচ
একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, বিশ্ব এক মহামন্দার ভেতর দিয়ে চলছে। তাই সরকারের প্রতিটি আয়-ব্যয়ের হিসাব হতে হবে যৌক্তিক এবং প্রয়োজনের দাবির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সরকারি পরিচালন ব্যয়ও সাশ্রয়ী করতে হবে, যতটুকু না হলেই নয়। এ জন্য অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস করতে হবে। সরকারের উচিত সব বিভাগকে কমপক্ষে ৫০ ভাগ খরচ কমানোর নির্দেশ দেওয়া। সব মহল থেকে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কথা বলা হলেও আগামী অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প থেকে সরে আসার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আরও দক্ষতা আনতে হবে। এগুলো যাতে দ্রুত মানুষের উপকারে আসে, সে উদ্যোগ নিতে হবে।
সর্বোপরি করোনা মহামারির আঘাতে অর্থনীতির লন্ডভন্ড দশায়, দেশ গঠনে ও আমাদের খেয়েপরে বাঁচার তাগিদে আগামী বাজেটে সুশাসন, অপচয় রোধ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার শতভাগ সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।