ইংরেজের শখের বাগান এখন আমের গঞ্জ

সুলতানি আমলের মুসলিম স্থাপত্যকলার এত নিদর্শন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো আর কোনো জেলায় নেই। এ ছাড়া গোটা জেলা শতবর্ষীসহ নানা জাতের আমগাছের ছায়ায় ঘেরা। মন কাড়বে গম্ভীরা অথবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি।

নানা জাতের বড় বড় আমগাছ নিয়ে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো কানসাট রাজার বাগানছবি: প্রথম আলো

খাবারে আম ও কালাই রুটি, সংস্কৃতিতে গম্ভীরা আর আলকাপ গান। বিপ্লবে ইলা মিত্র অথবা স্থাপত্যে সুলতানি নিদর্শন। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে চেনানোর তালিকায় আরও আছে আলপনা গ্রাম, নকশিকাঁথাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি।

‘হেরিটেজ ট্রাভেলার’ ও ‘ভ্রমণকন্যা’ হিসেবে খ্যাত এলিজা বিনতে এলাহীর মতে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আর কী লাগে! শুধু দরকার যথাযথভাবে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।

প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের উল্লেখযোগ্য জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সুলতানি আমলের মুসলিম স্থাপত্যকলার এত নিদর্শন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো আর কোনো জেলায় নেই। গৌড়বঙ্গের এই জনপদে আছে সেন আমলের প্রাচীন নিদর্শন নওদা বুরুজ (উঁচু ঢিবি)। এ ছাড়া গোটা জেলাই শতবর্ষীসহ নানা জাতের আমগাছের ছায়ায় ঘেরা।

আমকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে জেলা প্রশাসন বেছে নিয়েছে কানসাট রাজার বাগানকে। নানা জাতের বড় বড় আমগাছ নিয়ে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো কানসাট রাজার বাগান। জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর একটি ধরা হয় এই বাগানকে।

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেড়াতে এসে সুস্বাদু নানা জাতের আমের পুরোনো সব বাগান দেখতে চান যাঁরা, তাঁদের যেতে হবে কানসাট রাজার বাগানে। শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে এর অবস্থান। রাজার বাগান বলা হলেও বাগানটি কোনো রাজার তৈরি নয়। বাগানটি ছিল ময়মনসিংহের জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও সিতাংশু কান্ত আচার্য চৌধুরীদের মালিকানাধীন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য বইয়ের লেখক ও নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মাযহারুল ইসলাম জানান, জমিদারদের তৈরি করা কোনো বাগান নয় এটি। মিস্টার হল নামে এক আমপ্রেমী ইংরেজ কানসাটে এই বাগান তৈরি করেন। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি জমিদারদের কাছে বাগানটি বিক্রি করে যান বলে জনশ্রুতি আছে। সেই কানসাটেই এখন গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার।

এ বাগানে ‘মেম পসন্দ’ নামে রয়েছে সুস্বাদু জাতের এক বিরাট আমগাছ। ধারণা করা হয়, কোনো এক ইংরেজ নারীর (সাধারণ মানুষ ডাকতেন মেম সাহেব) পছন্দের আম ছিল এটি। তাই এমন নামকরণ। এ ছাড়া এখানে রয়েছে আরও নানা অপ্রচলিত জাতের সুস্বাদু আমের গাছ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ঐতিহ্য যে বহু পুরোনো, এ আমের বাগানটি তার একটি প্রমাণ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাগানটিকে ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাঙ্গো মিউজিয়াম’-এ রূপান্তরের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, এ বাগানে জনপ্রিয় বাণিজ্যিক জাতগুলোর বাইরেও নানা সুস্বাদু জাতের আমগাছ রয়েছে। নতুন করে আরও কিছু জাতের চারা রোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ বাগানে ৫০ জাতের আমগাছ আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০টি জাত সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

অনেক আগে এই বাগানে হর্টিকালচার সেন্টারের অধীনে একটি নার্সারি ও পুরোনো ভবন ছিল। সে ভবন সংস্কার করে পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এ বাগানের বড় বড় গাছের ওপর ‘ট্রি-হাউস’ তৈরির পরিকল্পনাও আছে বলে জানান মঞ্জুরুল হাফিজ।

জেলা প্রশাসনের ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাঙ্গো মিউজিয়াম’ প্রকল্পটি সম্প্রতি অনুমোদন পেয়েছে। ১০০ বিঘা আয়তনবিশিষ্ট বাগানটিতে উঁচু প্রাচীরসহ সুদৃশ্য একটি ফটক নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী আমের মৌসুমে পর্যটকেরা এখানে নিরাপদে অবস্থান করতে পারবেন। উপভোগ করতে পারবেন এ বাগানের সৌন্দর্য।

এর বাইরে জেলায় গৌড়বঙ্গের সুলতানি আমলের নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে ছোট সোনামসজিদ, দারাসবাড়ি মসজিদ, দারাসবাড়ি মাদ্রাসা, খঞ্জনদীঘির মসজিদ, ধনিচক মসজিদ, তাহখানাসহ আটটি স্থাপনা। সুলতানি আমলের ‘বালিয়াদীঘি’ নামের একটি বিরাট দিঘিও রয়েছে। এর মধ্যে সোনামসজিদ দেখতে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি হয়। মাসে প্রায় ১৫ হাজার দর্শনার্থী সোনামসজিদ, দারাসবাড়ি মসজিদ ও দারাসবাড়ি মাদ্রাসা দেখতে ১০ থেকে ১২ হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সোনামসজিদ কার্যালয় থেকে জানা গেছে।

কিংবদন্তিতুল্য কৃষকনেত্রী ইলা মিত্র বিংশ শতকের পাঁচের দশকের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে গড়ে তুলেছিলেন কৃষকদের ‘তেভাগা’ আন্দোলন। ইতিহাসের পাতায় এটি ‘নাচোল বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। বিপ্লবী এই নেত্রীর স্মরণে নাচোল উপজেলার নেজামপুর রেলস্টেশনের পাশে আছে ‘ইলা মিত্র স্মৃতি পাঠাগার’।

উদ্যোগ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর্যটনকে আকর্ষণ করতে জেলা প্রশাসনের নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে ‘দূরে কোথাও’ নামে একটি মুঠোফোন অ্যাপ ও ‘চলো বেড়াই চাঁপাই’ নামের ভ্রমণ নির্দেশিকা। এ দুটি তৈরি হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তাজকির-উজ-জামানের উদ্যোগে।

‘দূরে কোথাও’ অ্যাপে জেলার পাঁচ উপজেলার ২৩টি দর্শনীয় স্থানের তালিকা দেওয়া আছে। এসব দর্শনীয় স্থানে যেতে গুগল ম্যাপও যুক্ত করা আছে। জেলায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য পর্যটন মোটেল, রেস্ট হাউস, ডাকবাংলো ও বিভিন্ন হোটেলের ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বরও দেওয়া আছে এতে। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী খাবার, নকশিকাঁথা এমনকি যাতায়াতের জন্য কয়েকটি পরিবহনের মুঠোফোন নম্বরও মিলবে ‘দূরে কোথাও’ অ্যাপে।