ইতিহাসের দুই মহীয়সী নারীকে স্মরণ

ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যাঁদের হাত ধরে, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী ও লীলাবতী নাগ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন সময়ের সাহসী এই নারীরা। তবে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা ও চর্চার কারণে ইতিহাসে তাঁদের অবদান সেভাবে কখনোই প্রকাশিত হয়নি। এখন পর্যন্ত ভারত বা বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকেও তাঁরা সেভাবে স্থান পাননি। অথচ বর্তমানের নানা ঘটনাতেও এই দুই নারীর জীবন প্রাসঙ্গিক। তাই তাঁদের নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে।

রোববার ভারতের কলকাতার ‘ডায়মন্ড হারবার ইউনিভার্সিটি’–এর উইমেনস হিস্ট্রি কনক্লেভ আয়োজিত ‘স্মরণে সরলা দেবী চৌধুরানী এবং লীলা নাগ’ শিরোনামে আলোচনা সভায় ভারত ও বাংলাদেশের আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন। উইমেনস হিস্ট্রি কনক্লেভের আহ্বায়ক ভাস্বতী চ্যাটার্জি ও অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দুই বাংলার নারীনেত্রীসহ অন্যরা সভায় বক্তব্য দেন।

১৮৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন সরলা দেবী চৌধুরানী। তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাঙালি বুদ্ধিজীবী। তিনি ভারতের প্রথম নারী সংগঠন ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেন। নারীদের বিকল্প কংগ্রেসের কথা চিন্তা করেন। নারীদের স্বনির্ভর করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডার তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।

লীলাবতী নাগ ১৯০০ সালে আসামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রবর্তী সৈনিক। তবে তিনি শুধু রাজনীতিতেই তাঁর কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নারীশিক্ষা এবং নারীদের রাজনীতিসচেতন করে তোলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দীপালী সংঘ’ নামে নারী সমিতি।

ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের নেত্রী সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম বলেন, লীলা নাগ জেল খেটেছেন বহুবার। জেলখানাতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়ও সবাইকে সাহায্য করতেন তিনি।

লীলা নাগের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে মালেকা বেগম কবি সুফিয়া কামালের প্রসঙ্গ আনেন। লীলা নাগের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানে নারী আন্দোলনের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। মালেকা বেগম জানান, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার লীলা নাগকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ স্কুলের নাম বদলে ‘শের-এ-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়’ করেছিল।

মালেকা বেগম জানান, লীলা নাগ ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ নামে বিদ্যালয়। ১৯৩১ সালে প্রকাশ করেন জয়শ্রী নামক নারীদের পত্রিকা। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি কমিটি। ১৯৩৯ সালের ১৩ মে ঢাকার বিপ্লবী সংগঠন শ্রী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা নেতা অনিল রায়ের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি পরিচিত হন ‘লীলা রায়’ নামে। ১৯৭০ সালে মারা যান তিনি।

মালেকা বেগম বলেন, শিক্ষা ও শিক্ষাকেন্দ্রে মানবিক-সাংস্কৃতিক-আদর্শসংকট, তরুণসমাজের একাংশের আদর্শ বিচ্যুতি ও পরিবার বিচ্ছিন্নতার সংকট, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের নৃশংসতার অন্ধকার সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে লীলা নাগের জীবনচর্চা কিছুটা হলেও পথ দেখাচ্ছে।

লোরেটো কলেজের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, গবেষক তপতী সেনগুপ্ত সরলা দেবী চৌধুরানীর জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানীর মামা। ভার্চ্যুয়াল এই আলোচনা সভায় সরলা দেবী চৌধুরানীর শ্বশুরবাড়ির সদস্য অশোক দত্ত চৌধুরী চণ্ডীগড় উপস্থিত ছিলেন।

তপতী সেনগুপ্ত বলেন, ভারতের নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী। দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করলেও বিভিন্ন সময় তাঁর নিজের জীবনের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃতি, গণিতশাস্ত্রে পারদর্শী। ১৮৮৬ সালে এন্ট্রান্স ও ১৮৯০ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন তিনি।

ভারতের গবেষক, অনুবাদক, নারী আন্দোলনের কর্মী শর্মিষ্ঠা দত্ত গুপ্ত দুজন আলোচকের বক্তব্য নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, লীলা নাগকে নিয়ে চর্চা বাংলাদেশে বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে সরলা দেবীর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়েও তেমন কিছু জানা যায়নি। ইতিহাসে পিতৃতন্ত্র লুকিয়ে আছে। ইতিহাসে সরলা দেবী চৌধুরানী ও লীলা নাগের অবদানকে তুলে ধরতে হলে তাঁদের জীবনের নানা দিক নিয়ে গবেষণার পরিসর বাড়াতে হবে। আলোচনা পর্বের শেষে আলোচকেরা বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।