ইতিহাসের পথ ধরে বর্তমানে

কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার
ছবি : সংগৃহীত

কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের রচনায় বিভিন্ন শ্রেণির ও কালের নারীর ভোগান্তি আর সংগ্রামের কাহিনি ইতিহাসের পথঘাট ঘুরে বর্তমানের ময়দানে আছড়ে পড়ে। তিনি লেখালেখিতে আসেন অনেকের চেয়ে বেশ পরে; গ্রন্থসংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম। তবে এই সবকিছু তুচ্ছ করে প্রাথমিকভাবে গল্পকার এবং পরবর্তীকালে সফল ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি সাহিত্যজগতে পোক্ত স্থান করে নেন।

বেশ কিছু গল্প ও হাতে গোনা কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে তালাশ উপন্যাসটি নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হলেও চলতি বছরে এশিয়া লিটারারি পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে। তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে শাহীন আখতার বরাবরই আলোচিত। এবার এশিয়া লিটারারি পুরস্কারের তৃতীয়টি ঘোষিত হয়েছে এবং বাংলায় সাহিত্য রচনা করে এই পুরস্কার অর্জন এই প্রথম। উপন্যাসটির পাতায় পাতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার নারীদের দুঃসহ জীবনকে সুনিপুণভাবে এঁকেছেন। অন্যদিকে ইতিহাসকে টেনে এনেছেন খোদ বর্তমানে। তাই এ কেবল বহুল প্রচারিত বিচিত্র উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত ধর্ষণের বর্ণনা বা ছবি নয়, বরং উল্টো; তিনি মূলত ধর্ষণের শিকার নারীদের বেঁচে থাকার সীমাহীন যন্ত্রণা ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের প্রবঞ্চনার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।

শাহীন আখতার

কথাসাহিত্যিক

জন্ম

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, চান্দিনা, কুমিল্লা

পড়াশোনা

অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

লেখালেখি

পাঁচটি উপন্যাসসহ গল্পগ্রন্থ লিখেছেন ছয়টি

অর্জন

এশিয়ান লিটারারি অ্যাওয়ার্ড (২০২০)

জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)

বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৬)

আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার (২০১৫)

বাংলার পাঠশালা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)

ভারতের আনন্দবাজার গ্রুপের টিভি চ্যানেল এবিপি আনন্দ কর্তৃক সাহিত্যে ‘সেরা বাঙালি’ সম্মাননা (২০১৪)

প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১০ (২০০৩)

তালাশ-এর আগে তিনি পালাবার পথ নেই (১৯৯৭) নামে উপন্যাস রচনা করেন, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুটি মেয়েকে নানা ধরনের সংগ্রাম ও অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করতে দেখা যায়। পরে তিনি মানুষের দৈনন্দিন মানসিক ও সামাজিক টানাপোড়েনকে উপন্যাসের বিষয় হিসেবে না নিয়ে চলে যান ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস রচনায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বহু গবেষণাকাজের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, দাপ্তরিক গবেষণাকাজের মাধ্যমে তালাশ উপন্যাসের মূল বিষয়, একাত্তরে নিগ্রহের শিকার বহু নারীর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল হন। তবে বিষয়বস্তু পাবার পরেই যে তিনি তা উপন্যাস আকারে লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করেন, তা নয়; বরং গবেষণাকাজটি শেষ করার দুই-তিন বছর পর তাঁর ভেতরে বিষয়টি নিয়ে উপন্যাস লেখার তাগিদ বেড়ে যায়। নিগ্রহের শিকার নারীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভয়ানক অভিজ্ঞতা ও তার জের ধরে তাঁদের বর্তমানের পলায়ন-ইচ্ছুক জীবনের বেদনা হয়তো তিনি অন্তরে ধারণ করে ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকবেন, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই উপন্যাসে। নারী-যোদ্ধাকেন্দ্রিক তালাশ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বয়ান হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার কাছে আবেগের, আনন্দের আর গৌরবেরও। কিন্তু ধর্ষণ বা নিগ্রহের শিকার একজন নারীর কাছে তা নয়। একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবার সমাজে বুক ফুলিয়ে চলছে, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা কি তা পারছে? উপরন্তু ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব যেন তাকে সমাজ থেকে আলাদা আর অস্পৃশ্য করে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই সব নিয়েই শাহীন আখতারের উপন্যাস তালাশ, মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি হলেও সমাধান না হওয়া এক অধ্যায়ের হদিস। উপন্যাসটি পাঠককে নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে সমাজে প্রত্যেকে কি মুক্ত-স্বাধীন হয়েছে? কেউ কি নতুন করে পরাধীন জীবন বরণ করেনি?

এরপর মোটামুটি দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আরও কয়েকটি উপন্যাস লেখেন শাহীন আখতার—সখী রঙ্গমালা (২০১২), ময়ূর সিংহাসন (২০১৪), ও অসুখী দিন (২০১৮)। বলা বাহুল্য, প্রথম দুটোই ইতিহাসভিত্তিক এবং আলোচিত তালাশ-এর সময়কাল থেকে আরও পেছনের দিকে তিনি ভ্রমণ করতে থাকেন। একের পর এক ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে আকর্ষণীয় উপস্থিতির কারণে মনে হতে পারে, অতীতের দুরূহ অধ্যায়গুলো যেন লেখককে মানসিকভাবে তাড়া করে ফেরে। সেই তাড়নায় তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা কিংবা দেশভাগ ও তার আগের-পরের সামাজিক উত্থান-পতনের যুগে। লেখক মূলত ইতিহাসকে ভিত্তি করে উপন্যাস লেখেন এবং রাজনীতি বা রাজনৈতিক পরিবর্তন কীভাবে সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে, তা বিবৃত করতে পছন্দ করেন। উপন্যাসে চরিত্রের বক্তব্য ও কাহিনির মারপ্যাঁচে পরিবর্তিত সামাজিকতা ও জীবনযাপনের রহস্য খোঁজেন, এই উদ্দেশ্য সফলও হয়। তবে লেখক উপন্যাসে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক আদর্শসংবলিত বক্তব্য দেন না। সমাজ ও রাজনীতিকে নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিবেচনার কঠিন কাজটি তিনি উপন্যাসে করে থাকেন।

পাঠক সরাসরি রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা পান না, তবে উপলব্ধি করতে পারেন একজন ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকসচেতনতা থাকা কতটা জরুরি। কল্পকাহিনি-লেখকের যে দায়িত্ব, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও তার ফলে সমাজের পরিবর্তনগুলো নিবিড়ভাবে অবলোকন ও উপলব্ধি করা, তা শাহীন আখতার অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গে করে যান।

চমকপ্রদ বিষয় ছাড়াও, গদ্যের বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও নানা রকমের ভিন্নতা বা অভিনবত্ব শাহীন আখতারের স্বভাবজাত। যেমন, সখী রঙ্গমালা যদিও রঙ্গী-রাজচন্দ্রের প্রেমকাহিনি, কিন্তু একটি প্রেমকে ঘিরে তিনি ওই সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিচিত্র নারীর জীবনযাপনকে স্পর্শ করেছেন। নারী শরীরের আকুতি, আকাঙ্ক্ষা ও যৌনতার প্রতি ইতিবাচক আচরণ এখানে পদে পদে প্রকাশিত। কেবল প্রেম ও যাপন নয়, এই উপন্যাসে আছে অসাধারণ কৌতুকময়তা, যা পাঠককে হাসাতে গিয়ে হয়তো কাঁদিয়েই ফেলে; মানুষ যেমন কোনো কিছুতে অনন্যোপায় হলে তা নিয়ে কেবল কৌতুকই করতে পারে।

অন্যদিকে, অষ্টাদশ শতকের একটি পালাগানকে (চৌধুরীর লড়াই) কেন্দ্র করে সফল একটি উপন্যাস রচনা বিরল কৃতিত্ব বটে। পটভূমিটি এতটাই আগের যে, সে সময়কার অভিব্যক্তি বা ভাষা সম্পর্কে কল্পনা করা সত্যিকার অর্থে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু শাহীন আখতার সেখানে সরাসরি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার সাহসী ব্যবহার অবলীলায় চালিয়ে যান। পাঠক পড়তে গিয়ে হোঁচট খাবেন কি না, আদৌ বুঝতে পারবেন কি না—এ নিয়ে মাথা ঘামান না। প্রকৃতপক্ষে পাঠকের সুবিধা না ভেবে তিনি উপন্যাসের ভাষাগত সৌন্দর্যকে মুখ্য ধরে কাজ করেছেন, যা উপন্যাসটিকে ব্যতিক্রমী অবস্থান দিতে পেরেছে।

পরের উপন্যাস, ময়ূর সিংহাসন-এ লেখক অতীতের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। মোগল শাহজাদা সুজার পরাজয় ও পলায়নের কাহিনির ওপরে উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধ-বিগ্রহের আবহে মূলত সামন্ত যুগ বা মধ্যযুগের জীবন তিনি উপন্যাসে প্রতিফলিত করেন। শাহজাদার পালানোর পথে বিচিত্র মানুষ আসে আর তাদের বিচিত্র চরিত্র আশ্রয় করে উপন্যাসটি এগোতে এগোতে এসে পৌঁছায় আজকের অভিবাসনে বাধ্য রোহিঙ্গাদের রক্তাক্ত ইতিহাসে। বাদশাহের মৃত্যুর মাধ্যমে পটভূমি হয়ে ওঠে আজকের মিয়ানমারের ক্ষয়প্রাপ্ত রাখাইন রাজ্য। এই উপন্যাসেও আসে তৎকালীন নারীর জীবনের করুণ কাহিনির কথা, যারা মোগল হারেমে ‘অসতী’ আর প্রাণহীন পুতুলের জীবনযাপন করত। উপন্যাসটি মোগল হারেমের বর্ণনাকে কেন্দ্র করে মুসলমান বাদশাহদের ঔদ্ধত্য ও লাগামছাড়া জীবনযাপনের একটি সুচিন্তিত চিত্র।

দূরবর্তী ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে শাহীন আখতার হাল আমলে লিখেছেন অসুখী দিন উপন্যাসটি। উপন্যাসের পটভূমি দেশভাগের ঘটনা এবং তার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। দেশভাগ অখণ্ড ভারতের অন্তর্গত প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীর জীবনে বিশাল প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। অথচ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন তাঁরা দেশভাগ নিয়ে শিল্প রচনা করেছেন খুব কম। অন্যদিকে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে দেশভাগের ঘটনাজাত সামাজিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা তাঁদের রচনায় তুলে ধরেছেন। এদিকে বাংলাদেশে কেবল হাসান আজিজুল হককে উল্লেখ করা চলে। এমনিতে বিপ্লব-আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে সাহিত্য রচনা হয়েছে। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়তো সে ক্ষেত্রে ১৯৬৯, ১৯৪৭ আর ১৯৫২ সালের বিপ্লবকে ম্লান করে দিয়েছে। শাহীন আখতার সে রকম নির্জন ঘাটেই নোঙর করেছেন, যেখানে সচরাচর কারও পা পড়ে না, অসুখী দিন বিশেষভাবে উল্লেখ্য বা আলোচিত হবার এ-ও এক কারণ বটে।

২০১১ সালে দ্য সার্চ নামে তালাশ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে শাহীন আখতারের রচনা দেশের সীমা ছাড়িয়েছে। দিল্লির জুবান প্রকাশনী থেকে বইটি ইলা দত্তের অনুবাদে প্রকাশিত হয়। পরে কোরিয়ান ভাষায় উপন্যাসটি অনুবাদ করেন সিয়ং হি জিয়ন। অতিমারির কারণে গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল এবার অনলাইনে পুরস্কার দিলেও ২০২২ সালের আয়োজনে তালাশ নিয়ে আলোচনা ও সচিত্র প্রতিবেদনের পরিকল্পনা আছে। তালাশ ছাড়াও এই লেখকের সখী রঙ্গমালা বিলাভড রঙ্গমালা নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন শবনম নাদিয়া।

শাহীন আখতার কথাসাহিত্যের উপন্যাস অঙ্গনে একজন নিরীক্ষাকারী সাহিত্যিক। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের ফর্ম, কাহিনি, চরিত্র, পটভূমি এবং সময় ভিন্ন। এত ব্যাপক ভিন্নতা যখন একজনের কলম থেকেই বেরিয়ে আসে, তখন তা নিরীক্ষা ছাড়া আর কী! অথচ সফলতাটুকু এখানেই যে, রচনার গায়ে পরিশ্রমের ক্লান্ত-ছাপ নেই। দীর্ঘদিন ধরে পটভূমি বা চরিত্র নিয়ে গবেষণায়ও তাঁকে ভারাক্রান্ত করেনি। তাঁর রচনা তাই ইতিহাস-আশ্রয়ী কল্পকাহিনিই, নিছক ইতিহাস নয়।

  • আফসানা বেগম : কথাসাহিত্যিক; নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক