ইনটেলের প্রসেসরে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরও অবদান থাকছে

শায়েস্তাগীর চৌধুরী। কাজ করছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনটেল করপোরেশনের প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। পাশাপাশি পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন অধ্যাপকসহ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন নিয়ে গঠন করেছেন একটি গবেষণা দল। ইনটেলে তাঁর উদ্ভাবন, বিদেশে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সম্ভাবনা, গবেষণা দলের কাজসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আব্দুল্লাহ আল হোসাইন

শায়েস্তাগীর চৌধুরী

প্রশ্ন :

বুয়েটের কোন ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাশ করি। আমি বুয়েটের ৮৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

প্রশ্ন :

কর্মজীবন কোথায় শুরু করেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: আমার লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেব। বুয়েটে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই ১৯৯৪ সালে। সেখানে পড়ানোর সুযোগ পাই দেড় বছর।

প্রশ্ন :

এরপর কি দেশের বাইরে চলে যান?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: পিএইচডির জন্য বৃত্তি নিয়ে আমি চলে আসি ইংল্যান্ডে। সেখানে যে বিষয়টা দেওয়া হয়েছিল, সেটা খুব একটা ভালো লাগেনি। তখন আমি সেমিকন্ডাক্টর (অর্ধপরিবাহী) ফিল্ডের দিকে যেতে চাচ্ছিলাম। পরে ইংল্যান্ড থেকে আয়ারল্যান্ড চলে যাই। ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটি সুযোগ করে দেয় মাইক্রো ইলেকট্রনিকস, মূলত ম্যাটেরিয়ালসের ওপর কাজ করার। সেখান থেকে তিন বছরে পিএইচডি শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট-ডক্টরেট করার সুযোগ পাই। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক্টরেটের এক বছর কাজ করেছি ইলেকট্রনিক ম্যাটেরিয়ালসের ওপর। ওটার চাহিদা তখন ভালো ছিল, কারণ নতুন ক্ষেত্র।

প্রশ্ন :

ইনটেল করপোরেশন, বিশ্বের বড় সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। সেখানে আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিল কীভাবে?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে কাজ করা অবস্থায় ইনটেল করপোরেশন আমাকে ডেকে নেয়। আমার একটা উদ্ভাবন দেখে তারা আমাকে নেয়। ১৯৯৯ সালে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) সেক্টরে যোগ দিই সিনিয়র প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সিনিয়র টেকনিক্যাল পদে যোগ দিতে গেলে অবশ্যই পিএইচডি থাকতে হবে। তারপর ইনডিভিজুয়্যাল কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করি। এ পদে নিজের প্রজেক্ট নিজেই খুঁজে বের করতে হয়, যা বিরাট চ্যালেঞ্জের। এরপরের পদটাই হচ্ছে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে এ পদে আছি। এখন মূলত ইনটেলের পরবর্তী প্রজন্মের মাইক্রোপ্রসেসরের রোডম্যাপ তৈরির গবেষণা করছি।

প্রশ্ন :

প্রকৌশলী হিসেবে আপনি ইনটেলে কীভাবে অবদান রাখছেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: আমাদের দুইটা প্রধান ফোকাস থাকে। একটা হচ্ছে আরঅ্যান্ডডি সেক্টর, এখানে আমরা নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করি। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও ভাবনা দেওয়া। উদ্ভাবনের পর এগুলোর মেধাস্বত্ব হয়ে যায়, পাবলিকেশন হয়ে যায়। আমরা যখন দেখি গবেষণার মাধ্যমে মাইক্রোপ্রসেসরের প্রোটোটাইপ তৈরি করতে পেরেছি এবং তা কাঙ্ক্ষিত চাহিদা অনুসারে তৈরি হয়েছে, তখন আমরা উৎপাদনের জন্য পাঠিয়ে দিই। আমরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি এবং এর পাশাপাশি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো উদ্ভাবন করে থাকি। উৎপাদিত যন্ত্রাংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। আপনি যে ল্যাপটপটা ব্যবহার করছেন, হয়তো কোনো না কোনো ক্ষেত্রে সেখানে আমার একটা ইন্টারঅ্যাকশন ছিল।

ইনটেলের আরঅ্যান্ডডি বিভাগের একটাই সফলতা--- আমরা নিজেদের মতো করে ম্যাটেরিয়াল ডিজাইন করতে পারি, যা অন্য অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের নেই। আমরাই অনেক কিছু প্রথম উদ্ভাবন করেছি, এবং সবাই আমাদেরটা অনুসরণ করে।

প্রশ্ন :

ইনটেলে আপনার উল্লেখযোগ্য একটি উদ্ভাবনের গল্প যদি শোনান...

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: ১৯৯৯-২০০০ সালে ট্রানজিস্টরে কপার তারের প্রযুক্তি ইনটেলই বিশ্বে প্রথম উদ্ভাবন করে। সেখানে আমার অবদান আছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আমার একটি মেধাস্বত্ব প্রকাশ হয়েছিল। তাইওয়ানের বিজ্ঞানীসহ আমি তখন একটা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলাম, যাকে বলা হয় ‘ইলেক্ট্রোলেস ডেপোজিশন টেকনিক’। এর মাধ্যমে ন্যানো মাত্রায় কপার তার তৈরি করি, যা ট্রানজিস্টরের কাজে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রানজিস্টরের একটা অংশ দিয়ে বিদ্যুৎ কীভাবে প্রবেশ করবে, সেটাই উদ্ভাবন করেছিলাম যার মাধ্যমে ট্রানজিস্টরের পারফরম্যান্স বেড়ে গেল।
ইনটেলে সব মিলিয়ে ২০টির বেশি উদ্ভাবন করেছি। এর মধ্যে কয়েকটির মেধাস্বত্ব প্রকাশ করেছে ইনটেল শুধু জানান দেওয়ার জন্য। বাকিগুলো প্রকাশ করেনি, কারণ অন্য কেউ প্রযুক্তিটা ব্যবহার করতে পারে।

শায়েস্তাগীর চৌধুরী

প্রশ্ন :

পরিশ্রম করে এত দূর এসেছেন। অবসরের আগে আর কী কী করতে চান?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: আমি আসলে এ জায়গাটায় অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন। আমার মনে হয়, আমি এক জায়গায় আছি, কাজে সন্তুষ্টি পাচ্ছি। যেহেতু এখানে কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আছে, তাই এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আরেকটা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কথা ভাবিনি। আমি মনে করি, আমার কাজে গুণগত মান থাকবে এবং সেই গুণই আমাকে টেনে তুলে নেবে। এমনকি এখানে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ারের পর ইনটেলে ফেলো হব, আমি এভাবেও চিন্তা করিনি।

প্রশ্ন :

ইনটেলে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সম্ভাবনা কেমন? যেসব তরুণ প্রকৌশলী টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁদের বিষয়ে কী বলবেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: ইনটেলে আরঅ্যান্ডডি একটি বিরাট সুযোগের জায়গা। প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন দেশের মোট ১ লাখ ১০ হাজার কর্মী আছেন। আমাদের বাংলাদেশি প্রকৌশলীর সংখ্যা ২ হাজারের মতো। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও যে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, বিআইটি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি)--- এগুলো থেকে কাজ করতে এসেছেন তাঁরা। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ, রসায়ন, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এই ধরনের বহু বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের ইনটেল নিয়োগ দিয়ে থাকে। ইনটেলে প্রথমে একটা সুযোগ করে দেয়। প্রথম দুই বছর যদি আমি পরিশ্রম করে তাদের দেখাতে পারি যে আমি সত্যিকার অর্থে একজন কন্ট্রিবিউটিং ইঞ্জিনিয়ার, ওরা যদি বুঝে ফেলে যে ইনটেলের স্থির করা লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে আমি অবদান রাখছি তাহলে পরবর্তী ধাপে যাওয়া খুবই সহজ। এটার জন্য প্রচণ্ড নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। ফোকাস লাগে, সময়ও দিতে হয়।

আমার মতে, বড় বিষয়টা হলো আমি আসলে কী করতে চাই, তার পরিকল্পনা করা। এই জিনিসটা ধীরস্থিরভাবে বুঝে নিতে হবে। অনেকের মধ্যে অল্প পরিশ্রম করে ভালো করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আমরা যখন ইন্টারভিউ নিই তখনও প্রশ্ন করি, তোমাকে কাজটা কাল জমা দিতে হবে, সঙ্গে অন্য কাজগুলোও রয়ে গেছে। এটা তুমি কীভাবে ব্যালান্স করবে? এই জিনিসটা হয় কাজের প্রতি নিবেদন থেকে। এমন অনেক রাত গেছে আমি ঘুমাইনি। এমন অনেক সময় গেছে আমার ইনটেলের ভেতরে টাস্কফোর্সে বসে সমাধান দিতে হয়েছে। আমি বাংলাদেশ থেকে ওই ফোকাসটা ঠিক করেই এসেছি। এই যে মানসিকতা, একজন প্রকৌশলীর জন্য এটা একটা বিরাট ব্যাপার। বড় কিছু শুরুতে না দেখে, ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়া একজন ভালো প্রকৌশলীর বৈশিষ্ট্য।

প্রশ্ন :

টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীরা কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের তুলনার ক্ষেত্রে কী বলবেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: সৎভাবে বলি, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে যারা পড়াশোনা করেন তাদের কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড কোনো অংশেই কম না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বেশি জানে। কাজেই নিজেকে ছোট করে তুলে ধরা চলবে না। আমাদের হয়তো সুযোগ কম, কিন্তু সেই জায়গাগুলো শিখে নিতে হবে নিজেদের ইচ্ছায়। এবং এই সুযোগ ইনটেল, গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম-- এসব বড় বড় কোম্পানি দিয়ে থাকে। এই সুযোগ নিলে ঘাটতি বছরখানেকের মধ্যে এমনিতেই চলে যায়।
আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) বিশেষ করে কানপুর ও খড়গপুর আইআইটির একজন শিক্ষার্থী যখন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন, তাঁর যে জ্ঞান এবং তা বাস্তবিক প্রযোগের সক্ষমতা, তা আমাদের ছেলে-মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। একজন চীনা শিক্ষার্থী প্রচণ্ড খাঁটেন, দিন-রাত বলে তাঁর কিছু নাই। ওঁদের কাজপাগল বলা হয়। তাঁদের সঙ্গে আমাদের তুলে ধরতে হবে। যদি আমার কোনো ঘাটতি থাকে, সেই ঘাটতি পূরণে আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। একটা ডিগ্রি নিয়ে বের হলেই যে প্রকৌশলী হয়ে গেলাম, তা কিন্তু না। প্রতিটা মুহূর্তে শিখতে হবে, প্রতিটা মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে।

প্রশ্ন :

আপনি এখনো শিক্ষকতা করছেন। ইনটেলে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি এটা কীভাবে সামলাচ্ছেন?

শায়েস্তাগীর চৌধুরী: আমি অরেগন অঙ্গরাজ্যে থাকি। ইনটেলের কাজ শেষে সন্ধ্যায় পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একজন অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর হিসেবে কাজ করি। আমার ওই আগ্রহটা আছে যে, আমি শিক্ষকতায়ও থাকব। আমি সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন বিষয়ে পড়াই এখানে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে অনলাইন ক্লাসেও একই বিষয় পড়াই। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স বিভাগের পাঁচজন অধ্যাপকসহ বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন নিয়ে একটি গবেষণা দল গঠন করেছি। ইনটেল মাইক্রোপ্রসেসরের ১০টা সার্ভার কম্পিউটার নিয়ে গিয়েছিলাম বিভাগগুলোর জন্য। উদ্দেশ্য ছিল সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা যখন বাস্তবে নতুন ম্যাটেরিয়াল উদ্ভাবন করি, তার সিমুলেশন করা যেন আমি প্রত্যাশিত ফলটা পাই। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে যদি কোনো উদ্ভাবন প্রমাণ করতে পারি, তখনই আমার গবেষণার ৬০ ভাগ কাজ শেষ, বাকি ৪০ ভাগ হচ্ছে বাস্তবিকভাবে তৈরি করা। বাংলাদেশে কোটি কোটি ডলার খরচ করে ল্যাবরেটরি তৈরি যেহেতু সম্ভব নয়, আমার দেশের মেধা দিয়ে শুধু সিমুলেশন করি। এতে ৬০ ভাগ গবেষণা কিন্তু হয়ে গেল। তাঁরা এ ধরনের নতুন নতুন উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যেমন, বালু থেকে সোলার সেল তৈরি করার কাজ এগিয়ে চলছে।