ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নানা দেশের কবিরা বাঙালির পক্ষে কলম ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে বিদেশি গবেষকেরাও এ ঘটনার দিকে না তাকিয়ে পারেননি। প্রথমে ভারতের, পরে পশ্চিমা দেশগুলোর। মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্ব নিয়ে তাঁদের বিবেচনা।

হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ৪ নভেম্বর ১৯৭১ছবি: সংগৃহীত

নভেম্বরের ৪ তারিখে ইন্দিরা গান্ধী হোয়াইট হাউসে পৌঁছান। তাঁকে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে পরবর্তী সব ঘটনা হয়ে উঠেছিল এককথায় বিপর্যয়কর। হেনরি কিসিঞ্জার আগে থেকেই রিচার্ড নিক্সনকে জনসমক্ষে হাসিমুখে উপস্থিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঝলমলে সেই রোদের সকালে হোয়াইট হাউসের দক্ষিণ উঠানে দুই নেতা চোখ–মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা দুজনে যেন বিষণ্ন বিদ্বেষের চাক্ষুষ প্রতিমূর্তি। এত কাছাকাছি উপস্থিতিতে দুজনেই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। শরতের হিমেল বাতাসে ইন্দিরা গান্ধী হালকা কমলা রঙের ওভারকোট পরে ছিলেন। তাঁর ঘাড় ডোরাকাটা ঘোমটায় ঢাকা ছিল, ওভারকোটটি ঠিক সেখান থেকেই ঝুলছিল। অন্যদিকে নিক্সন পেটের সঙ্গে আঁটসাঁট গাঢ় রঙের স্যুট পরেছিলেন, মাঝখানে প্রসারিত আর দুই পাশে সরু নৌকার মতো তাঁকে দেখাচ্ছিল।

কিসিঞ্জার পরে লিখেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী যে নিক্সনকে পছন্দ করেননি, তা সেটা তাঁর ‘শীতল অভিব্যক্তি’ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিসিঞ্জারের সহকারী স্যামুয়েল হসকিনসন দুই নেতার মধ্যকার উত্তেজনা ও পারস্পরিক ঘৃণা দেখে আহত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ওই ঘটনা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘দুই রাষ্ট্রপ্রধানেরা এখন মুখোমুখি, কিন্তু তাঁরা দুজন দুজনকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখছেন।’ ‘ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন নিক্সনের একেবারে বিপরীত চরিত্রের।’ তিনি লিখেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী ভেবেছিলেন তিনি একটা ইতিহাস সৃষ্টির মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন। পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে যাচ্ছেন।’

রাষ্ট্রীয় নৈশভোজটিও উজ্জ্বলতা হারিয়েছিল। যদিও উৎসবের আবহ তৈরি করার পর্যাপ্ত আয়োজন সেখানে ছিল। নিউইয়র্ক শহরের ব্যালে দল তাদের ঝলমলে পরিবেশনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। ফার্স্ট লেডি প্যাট নিক্সন মেঝে পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন গাউন পরে এসেছিলেন। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গোলাপি রঙের গাউনটিতে ছিল ১৯৭০-এর দশকের ফ্যাশনের ছাপ। সোনার কারুকাজ করা লাল শাড়িতে ইন্দিরা গান্ধীকে কিছুটা অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। টক্সিডো স্যুটে নিক্সনকে বরং কিছুটা বেশি স্মার্ট দেখাচ্ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন অনুষ্ঠানটি খুব ভালো উপভোগ করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ করেছিলেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি রয়েছে। মেরিন কোরের ব্যান্ডকে গাইতে না দেওয়ায় নিক্সনের অভিমত ছিল, ‘সরকারের ভেতরটা সব ফালতু লোকজনে ভর্তি।’ নিক্সন বলেন, ‘কংগ্রেসের সদস্যরা সেখানে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁদের একদল বিরস মুখের বেজন্মার মতো মনে হচ্ছিল। সত্যিই তাঁদের সে রকম দেখাচ্ছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের লোকজনের অবস্থা ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই।’

তিনি বলেছিলেন, তাঁর প্রধান সান্ত্বনা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর জন্য একটা সত্যিকারের আনন্দঘন মচ্ছব কামনা করা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুত করা কোনো লিখিত বক্তব্য ছাড়াই সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন বিদেশ নীতির ব্যাপারে তিনি কতটা পারদর্শী, সেটার নজির দেখিয়ে। তিনি অহংকার করে বলছিলেন, ‘আমি বিশ্বের অন্য যে কারও চেয়ে উৎসবের ভালো শুভেচ্ছাবার্তা দিতে পারি, স্বাগত বক্তব্য দিতে পারি। আমি বিশ্বের সবখানেই গিয়েছি।’

‘হ্যাঁ, সেটার ফলাফলে সেই প্রশংসা বেশ ভালোভাবেই পাওয়ার যোগ্য আমি। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম আমি...।’
ইন্দিরা গান্ধী

এত সব আয়োজনের পরও গান্ধী এবং পি এন হাকসার শীতলই থেকে গেলেন। ভারতীয়রা বিস্মিত হয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট তাঁর বক্তব্যে বাংলার সংকট নিয়ে একটি কথাও উল্লেখ করেননি। ইন্দিরা তাঁর বক্তব্যের সময়ও খুশির অভিব্যক্তি দেখাননি। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘মিশিগান রাজ্যের সব মানুষ হঠাৎ নিউইয়র্ক রাজ্যে চলে এল, ভেবে দেখুন তো এমন একটা ঘটনা? আপনাদের দেশে কি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অন্য কোনো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায্যতা থেকে পালিয়ে আসেনি? আপনারা কি তাদের জন্য আপনাদের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখেননি?’

নৈশভোজ অনুষ্ঠানে খোশেমজাজে ছিলেন কিসিঞ্জার। (পরবর্তী সময়ে তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, ব্যালে আমার ভালো লেগেছে।) যদিও পরদিন সকালে ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার দুজনেই নৈশভোজের অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধী কী কী ভুল করেছেন, সেই খুঁত বের করতে উঠেপড়ে লাগলেন। হোয়াইট হাউসের স্টাফদের প্রধান এইচ আর হ্যালেডম্যানের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করে কিসিঞ্জার বললেন, ‘বুঝলেন, গত রাতে ইন্দিরা গান্ধীর মাথা একেবারে গেছিল।’ কিসিঞ্জার বললেন, ‘হোয়াইট হাউসে আমাদের আসার পর থেকে এ পর্যন্ত সেরা একটা স্বাগত বক্তব্য দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। অতিসূক্ষ্ম, খুব চিন্তাশীল এবং উষ্ণ হৃদয়ের বক্তব্য। খুব, খুব অনন্য। আর ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দিতে উঠলেন, প্রেসিডেন্টের কোনো প্রসঙ্গই তুললেন না, মিসেস নিক্সনের সঙ্গে তাঁর কী একটা বন্ধুত্বের কথা বললেন, এরপর সরাসরি পাকিস্তানের দীর্ঘ সমালোচনা শুরু করলেন। তুমি বলতে পারো, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে আগে এ রকমটা কেউ করেছে কি না। কেউ অন্য কোনো দেশের সরকারকে এভাবে কেউ আক্রমণ করেনি।’ (ইন্দিরা তাঁর বক্তব্যে পাকিস্তানের নাম এড়িয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু বলেছিলেন ‘মধ্যযুগীয় স্বৈরশাসক’।)

গান্ধী তাঁর বক্তব্যে নিজ দেশের জনগণের কাছ থেকে পাওয়া গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের বিষয়টি উল্লেখ করেন। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে কিসিঞ্জার বলতে শুরু করেন, এরপর তিনি নিজের প্রশংসা নিজে শুরু করে দিলেন। ইন্দিরা বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটার ফলাফলে সেই প্রশংসা বেশ ভালোভাবেই পাওয়ার যোগ্য আমি। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম আমি...।’ এবং তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে যেটা করেছে, সেই একই আচরণ তাদের সঙ্গে করা হলে সেটা আমাদের জন্য ভুল হতো।’ তিনি বলেন, ‘...ওহ, তারা এটা করলে যেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সত্যিকারের বিদ্রোহ করা হতো!’

নভেম্বরের ৫ তারিখ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওভাল অফিসে আসার আগে কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টকে সর্বশেষ উৎসাহব্যঞ্জক বিবৃতি দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিসিঞ্জার দেখলেন, নিক্সন এরই মধ্যে খেপে গেছেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ভারতকে যে পরিমাণ ত্রাণসহায়তা দিয়েছে, সেটা বাকি বিশ্ব সম্মিলিতভাবে যা দিয়েছে, তার থেকে বেশি। এবং তারপর তিনি রেগে ফেটে পড়লেন আর চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, ‘কেন তারা এ সহযোগিতার জন্য আমাদের কোনো কৃতিত্ব দেয় না? কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টের রাগ আরও তাতিয়ে দিলেন। বললেন, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমাদের এতটা রক্ষণাত্মক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি না। কেননা, এই বেজন্মরা আমাদের সঙ্গে চূড়ান্ত বর্বর ও নিষ্ঠুর খেলা খেলছে।’

‘আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কঠোর হতে যাচ্ছি।’
রিচার্ড নিক্সন

ইন্দিরা গান্ধীকে যাতে বুঝ দেওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন কতগুলো পদক্ষেপের তালিকা দিলেন কিসিঞ্জার। সেগুলো হলো, ‘দুর্ভিক্ষে ত্রাণসহায়তা, আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার উপস্থিতি, বেসামরিক সরকার, অ্যামনেস্টির উপস্থিতি, বহু পক্ষের উপস্থিতিতে সেনা প্রত্যাহার।’ তিনি বললেন, ‘অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়েছে।’ এ সময়ে নিক্সন যুক্ত করলেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মুজিবকে প্রাণদণ্ড না দিতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তানিরা। (নিক্সন জিজ্ঞাসা করলেন ‘তাঁর নাম কী? মুজিব? কীভাবে নামটা উচ্চারণ করো?’) কিসিঞ্জার বললেন, ‘আর ইয়াহিয়া বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হয়েছেন,’ যদিও সেই নেতা মুজিব নন। নিক্সন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই না’? কিসিঞ্জার উত্তর দিলেন, ‘না, না না।’ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে ‘ইয়াহিয়ার জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যার মতো ব্যাপার’। নিক্সন চড়া গলায় যেন গান্ধীকে শুনিয়ে বললেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন ভারতের কোনো চুক্তি নেই, তখন তারা অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘একটা নৈতিক অঙ্গীকারে আসতে বাধ্য’। এরপর সারমেয়র মতো খেঁক করে উঠে অনুপস্থিত গান্ধীর উদ্দেশে বললেন, ‘ধুমসি মেয়েমানুষ।’

কিসিঞ্জার নিক্সনকে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কঠোরতা দেখাতে বললেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বললেন, ‘আমার ধারণা, প্রকাশ্যে আপনার খুবই ভালো থাকা উচিত,’... (এ অংশে এসে ধারণকৃত অংশটি মুছে ফেলা হয়েছে, আরও কঠোর হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত আলাপকালে কিসিঞ্জার কী ভাষা ব্যবহার করতে বলেছেন, সেটা যাতে বোঝা না যায়।) সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইন্দিরা যে চুক্তি করেছেন, সেটা ভারতের জোট নিরপেক্ষ অবস্থানকে জলাঞ্জলি দিয়ে করা হয়েছে এবং ‘পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়টা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়’—এ দুটি বিষয়ের প্রসঙ্গ তুলে কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টকে ইন্দিরা গান্ধীকে শক্ত করে ধরতে বললেন।

কিসিঞ্জারের এই ব্রিফিংয়ের পর নিক্সন সুস্থিরচিত্ত হলেন। পাকিস্তানিদের জন্য কী করা যাবে, সেটা পেয়ে যাওয়ায় প্রেসিডেন্টকে বেশ সপ্রতিভ মনে হলো। শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে হোঁচট খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘তারা মুজু...মুজুকে—তুমি কী যেন বললে তাঁর নাম, হ্যাঁ, পাকিস্তানিরা তাঁকে প্রাণদণ্ড না দিতে সম্মত হয়েছে।’ কিসিঞ্জার বললেন, ‘মুজিব।’ নিক্সন খুব সাবলীলভাবে পাকিস্তানিদের স্বার্থের বিষয়গুলো, যেমন বেসামরিক সরকার এবং বহু পক্ষের উপস্থিতিতে সৈন্য প্রত্যাহার বিড়বিড় করে আওড়ে গেলেন। প্রেসিডেন্ট শেষ করলেন, একমাত্র বিকল্প হলো, ‘আত্মীকরণ অথবা যুদ্ধ।’ তিনি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত হলেন।

নিক্সন বললেন, ‘আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কঠোর হতে যাচ্ছি।’

অবশেষে রিচার্ড নিক্সন ও ইন্দিরা গান্ধী ওভাল অফিসে মুখোমুখি বসলেন। একটি উত্তপ্ত ও দীর্ঘ বৈঠকে দুই রাষ্ট্রপ্রধান যেন মল্লযুদ্ধে মেতে উঠলেন। শুধু কিসিঞ্জার আর হাকসারই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গী হলেন। পরিবেশটা ছিল বিস্ফোরক। কিসিঞ্জার ভাবছিলেন ইন্দিরা যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়েছেন। আর ইন্দিরা ভাবছিলেন একটা গণহত্যার সহায়তা দিয়েছেন কিসিঞ্জার।

শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ত্রাণসহায়তা দিয়েছে, কিসিঞ্জার প্রথমে সে প্রসঙ্গটি তুললেন। এরপর হঠাৎ করেই সতর্ক করলেন, একটা যুদ্ধ শুরু করা অগ্রহণযোগ্য। তিনি বললেন, পাকিস্তানের ওপর কিছুটা প্রভাব রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন এবং এর অর্থ হচ্ছে ‘একেবারে সীমিত’ পরিসরে সামরিক সরবরাহ বজায় রাখা। পাকিস্তানের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাতলানো পথগুলো বারবার আওড়ে গেলেন তিনি। যেমন পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো, পূর্ব পাকিস্তানের একটা বেসামরিক সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্য নেতাদের সঙ্গে আলাপ, মুজিবকে হত্যা না করা এবং এখনই ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু সৈন্য প্রত্যাহার করা। যুক্তরাষ্ট্রের এর থেকে বেশি করার ছিল না। ইন্দিরা নিক্সনের বক্তব্য শুনে গেলেন। কিসিঞ্জার পরে এই শ্রবণকে বলেছেন, ‘নির্লিপ্ত উদাসীনতা’। নিক্সন মুজিবের সঙ্গে কোনো ধরনের মীমাংসা হোক, সে ব্যাপারে সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি এমন কোনো নীতির পক্ষে নই, যেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়।’

নিক্সন বললেন, ভারত যুদ্ধে জিতে যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের যুদ্ধ ‘ধারণার চেয়েও বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষে পরাশক্তিরা জড়িয়ে পড়লে বিশ্ব শান্তির জন্য বিরাট হুমকি তৈরি হবে। ভারতে চীনের আক্রমণের বড় ধরনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, এই যুদ্ধ শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

ইন্দিরাকে কিছুটা ভোঁতা মনে হচ্ছিল। নিক্সনের চেয়ে তিনি ছিলেন কম কৌশলী। পরবর্তীকালে কিসিঞ্জার লেখেন, ‘তাঁর কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছিল, একজন অধ্যাপক পেছনের সারির একজন ছাত্রের গুণকীর্তন করছেন। নিক্সন “সেটা স্বচ্ছ চোখের নম্রতা” দিয়ে যেন গ্রহণ করছেন। নিজের অসন্তোষ প্রশমনের সময় নিক্সন এ কৌশল ব্যবহার করতেন।’ পাকিস্তানে জাহাজভর্তি অস্ত্রের চালান পাঠানোর ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ক্ষোভ জানালেন। জনগণকে শান্ত রাখার সব চেষ্টার পরও তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বলে জানালেন গান্ধী।

পাকিস্তান যে ক্রমাগত ‘ভারতবিদ্বেষী’ প্রচারণা চালাচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধী ঘুরেফিরে সেটা বলতে লাগলেন। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার আগের দুটি যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের এই ঘৃণামূলক প্রচারণাকে দায়ী করলেন তিনি। এরপর তিনি পাকিস্তানের কঠোর নিন্দা শুরু করলেন। তিনি বলেন, দেশটির জন্মের পর বিরোধী রাজনীতিকদের হয় জেলে পাঠিয়েছে, না হয় হত্যা করেছে। এ জন্য বেলুচিস্তান কিংবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠেছে। পাকিস্তানিরা যে ‘বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা’র মাধ্যমে বাংলার জনগণের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করছে, সেটা বলতে গিয়ে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। নিক্সনের কাছে ইন্দিরা পাকিস্তানিদের নৃশংসতার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র রাখার প্রচেষ্টা হবে অবাস্তব চিন্তা। স্বায়ত্তশাসনের চাপটা এখন অনেক শক্তিশালী।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এরপর ভারতে যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী তখনো প্রবেশ করছে, সে প্রসঙ্গটি তুললেন। (ভারতের হিসাব অনুযায়ী তখন পর্যন্ত ৯৫ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে)। নিক্সন ও কিসিঞ্জার ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধটাকে যে প্রেক্ষাপটে দেখা হচ্ছিল, সেটাকে কেটেছেঁটে ছোট করে আনলেন। নিক্সন বললেন, তিনি কংগ্রেসে শরণার্থীদের আরও বেশি ত্রাণসহায়তা যেন দেওয়া যায়, সে বিষয়ে চাপ দেবেন। শরণার্থীরা যাতে তাদের দেশে ফেরত যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু ইন্দিরা বললেন, ভরতের সীমান্ত রাষ্ট্র থেকে আসা শরণার্থীদের ভিন্ন প্রেক্ষাপট রয়েছে। তারা ভিন্ন ধর্মের। একটা রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে তাদের ছেড়ে দিতে পারে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে জাহাজ থেকে ত্রাণ খালাসে বাধা সৃষ্টি করায় নিক্সন বাঙালি বিদ্রোহীদের নিন্দা করলেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, এ জাতীয় গেরিলাযুদ্ধের জন্য অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রয়োজন। ইন্দিরা এই অভিযোগ এড়িয়ে গেলেন। তাঁর উত্তর ছিল ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি বললেন, ‘ভারত গেরিলা কর্মকাণ্ডে সহায়তা করছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।’ ওভাল অফিসে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কেউই এই বক্তব্য বিশ্বাস করেছেন বলে মনে হয় না। ইন্দিরা গান্ধী উদ্‌ভ্রান্তের মতো, ফ্লোরিডায় আশ্রয় নেওয়া কিউবান বিদ্রোহীরা যেভাবে কিউবাতে আক্রমণ করে, সেই তুলনা দিলেন।

দুই নেতা খুব উগ্রভাবে বাগ্‌যুদ্ধে জড়ালেন। এ বৈঠক সম্পর্কে পরে কিসিঞ্জার লেখেন, ‘দুজন বোবার মধ্যকার সংলাপের ধ্রুপদি এক দৃষ্টান্ত।’ ইন্দিরা খুব তিক্তভাবে ইয়াহিয়ার ‘ধর্মযুদ্ধ’-এর ব্যাপারে অভিযোগ তুললেন। তিনি বললেন, মুজিব হচ্ছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাঙালির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রতীক তিনি। নিক্সন ও কিসিঞ্জার সোভিয়েত চুক্তির প্রসঙ্গ তোলায় তিনি তাঁদের দুজনকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন। নিক্সন দাবি করলেন, তিনি পাকিস্তানকে ‘বিশাল চাপে রাখবেন’। এটা বলতে গিয়ে আবার তিনি ইয়াহিয়ার দেওয়া বহু পক্ষের উপস্থিতিতে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ তুললেন। হাকসার বিষয়টা পাস কাটাতে গেলে নিক্সন তাঁকে হাতের ঝাপটায় থামিয়ে দিলেন।

নিক্সন শেষ করলেন কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়ে। তিনি বললেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে, ইয়াহিয়াকে সংযত হতে বলবে এবং একটা রাজনৈতিক সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করবে। নিক্সন ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানের ঐক্য বিনষ্ট হলে সেটা কারও জন্যই মঙ্গল হবে না। এরপর গড়গড় করতে শুরু করলেন, ‘ভারত যে বৈরিতা শুরু করেছে, সেটা তাঁর পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব।’ তিনি সতর্ক করলেন, ‘ভারত যদি এই বৈরিতা অব্যাহত রাখে, তবে তাদের অসম্ভব মূল্য চুকাতে হবে। অন্য পরাশক্তি যুদ্ধে অংশ নিতে পারে।’ এর মধ্য দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া তিনি জানালেন না, চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসনের ইঙ্গিতও করলেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কুৎসিত এই শেষ মুহূর্তটিতে নিক্সনের হুমকিটি যেন ওভাল অফিসের বাতাসে ঝুলে রইল। সংক্ষেপিত

সূত্র: দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড, গ্যারি জে বাস,

গ্যারি জে বাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহকারী অধ্যাপক

অনুবাদ: মনোজ দে