ইসি গঠনে নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন দরকার

আইনের মাধ্যমে একটি ভালো নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলে ঐকমত্য দরকার। একই সঙ্গে নাগরিকদের আস্থা অর্জনের জন্য দরকার ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা। এ বিষয়ে মানুষের জানার সুযোগ করে দিতে হবে।

‘প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন: জন-আকাঙ্ক্ষা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তাদের কাছ থেকে মোটাদাগে এসব মতামত উঠে এসেছে। এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। বক্তারা ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন ইসি গঠনে সরকার আইন করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিলের ওপর সংসদীয় কমিটি মতামত দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গোলটেবিল আলোচনায় অধিকাংশ বক্তা সংশয় প্রকাশ করেছেন যে তাঁদের মতামত আইন প্রণয়নে আমলে নেওয়া হবে না। তবে ভবিষ্যতে আইনটির সংশোধনের প্রয়োজনে এই পরামর্শগুলো কাজে আসতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে, যাঁর কোনো দাগ নেই

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, আইনের প্রতিটি স্তরেই যদি অবিশ্বাস থাকে, তাহলে তো আইন করে খুব বেশি সুবিধা হবে না। আইনটির সঠিকভাবে প্রয়োগ হবে, এই বিশ্বাস রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করতে হবে।

এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘আইনের খসড়ায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি মনে করি, ইসি সচিবালয়কে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে এবং আইনে ইসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারের অধীন এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত।’

ইসি গঠনে সংসদকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে শামসুল হুদা বলেন, সার্চ কমিটিতে যে নাম সুপারিশ হিসেবে আসবে, সেগুলো সংসদীয় পর্যালোচনার (পার্লামেন্টারি হিয়ারিং) মধ্য দিয়ে যাবে। কাদের নাম সুপারিশ করা হচ্ছে, সেটা প্রকাশ করে দিতে হবে।

সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে কঠোর হওয়ার পক্ষে মত দিয়ে শামসুল হুদা বলেন, এখানে তিন-চারটি পদ। এর জন্য দেশে ভালো মানুষের অভাব হবে না। তিনি আরও বলেন, ইসিতে এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে, যাঁর পুরো জীবনে কোনো দাগ নেই।

নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের নিরপেক্ষতা দেখতে হবে

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসিতে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। একটি হচ্ছে তিনি নিরপেক্ষ কি না। দ্বিতীয়ত, তাঁর ভেতরে আইন প্রয়োগের সক্ষমতা ও সাহস রয়েছে কি না? নির্বাচনে শতাধিক লোক মারা যাওয়ার পরও কমিশনাররা বলছেন, তাঁদের কোনো দায় নেই। আসলে দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে।

ইসি গঠনে সংসদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করার পরামর্শ দেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না। ফলে সার্চ কমিটির বাছাই করা নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেই। এসব নাম সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানো যায়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও অন্য বড় দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আবার সবার মত থাকবে। সাধারণ মানুষও জানতে পারবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আবদুল আলিম বলেন, ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আন্তর্জাতিক নীতি-নির্দেশ আছে। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতা। কারা কমিশনে আসছে, তা প্রকাশ করে দিয়ে ব্যাপক যাচাইয়ের সুযোগ করে দিতে হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চার-পাঁচ মাস সময় নেওয়া উচিত।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের সময় সরকারের ধরনটা কেমন হয়, এর ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে। যত ভালো আইনই হোক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের মৌলিক পরিবর্তন লাগবেই।

এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চালক রওনক জাহান বলেন, ‘ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বচ্ছতা। এটা না থাকলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য আসবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঐকমত্য তৈরি কিছুটা দুরূহ হলেও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে স্বচ্ছতার দিকটা নিশ্চিত করা সম্ভব।

সুজনের সুপারিশ

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মূল প্রবন্ধে ইসি গঠনের আইন নিয়ে সুজনের ৬টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে—অনুসন্ধান কমিটিতে সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন করে সাংসদকে যুক্ত করা; বাছাই করা নামগুলো ওয়েবসাইটে বা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ; পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ইসি নিয়োগ।

আলোচনায় আরও অংশ নেন সুজনের সিকান্দর খান, শফিউদ্দিন আহমেদ, একরাম হোসেন, দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।