ইসি গঠনে সার্চ কমিটি ‘ধোঁকা’ দেওয়ার প্রক্রিয়া
নির্বাচন কমিশন গঠনে ‘সার্চ কমিটি’ একটি ধোঁকা দেওয়ার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে অযোগ্যদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে খুঁজে বের করা হয়। যার ফলে গত দুটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন প্রয়োজন। কিন্তু শুধু একটি ভালো নির্বাচন কমিশন হলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এ জন্য নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন।
আজ সোমবার ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ওই অনলাইন গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। তাতে সুজনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে প্রস্তাবিত আইনের প্রাথমিক একটি খসড়া তুলে ধরা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে একটি চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করা হবে। এরপর সেটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে সুজন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর–উল–ইসলাম বলেন, সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখেই কাজ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন করার ক্ষেত্রে সংবিধানের মধ্যে থেকে কী কী করা যায়, সেটি ভাবতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সংবিধান বদলানো যাবে না, এমনটা নয়। প্রয়োজনে সংবিধান সব সময় বদলানো যায়। তিনি মনে করেন, নির্বাচনকালীন সময়ে তিন মাসের জন্য আসা একটি সরকার তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। এ জন্য দরকার একটি জাতীয় সরকার।
সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। পরপর দুটি সার্চ কমিটির পারফরম্যান্স মানুষ দেখেছে, এ দুটি কমিটির অর্জন সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না। ভোটাররা ভোট দিতে চান না, কারণ তাঁরা মনে করেন, ভোট দিয়ে লাভ নেই। নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন করার জন্য জোরেশোরে আন্দোলন করা প্রয়োজন।
সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান মানতে হলে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন করতে হবে। তবে এ আইনই যথেষ্ট নয়। এই আইন অবশ্যই হতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের স্বার্থে। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি হয়, তা দলনিরপেক্ষ মানুষ দিয়ে হয় না। কমিটি অযোগ্যদের খুঁজে বের করে, যার ফলে সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সার্চ কমিটির নামে ধোঁকা দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এই কমিটি করার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নেই। সরকারের ইচ্ছায় এটি করা হচ্ছে, কারা এর সদস্য হবেন, সেটাও সরকারের ইচ্ছাতেই নির্ধারিত হয়। এই কমিটির মাধ্যমে গঠন করা দুটা নির্বাচন কমিশন নিয়ে অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ইসি গঠনে আইন দরকার। কিন্তু বাস্তবতাটাও মাথায় রাখতে হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন বর্তমান সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন একই থাকলে সাখাওয়াত হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার দিয়েও যদি কমিশন করা হয়, সেই কমিশনও কি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে? একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো, কিন্তু তারা কাজ করতে পারল না, তাহলে লাভ কি? নির্বাচনের সময় পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করতে হবে। বিদ্যমান কাঠামোতে কি সেটি সম্ভব? তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেটি হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতীয় সরকার বা অন্য কিছু।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তাঁরা যখন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন, ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে এটি নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। বড় কোনো দলকে এই আইন প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা করতেও দেখা যায় না। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে আর চার মাস। সময় খুব বেশি নেই। অবশ্য আইন তৈরি করতে চাইলে এই সময়ের মধ্যে তা সম্ভব।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় ঝাঁকুনি দিতে না পারলে কোনো কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। এককেন্দ্রিক সরকার যেভাবে চায় সেভাবে নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। না হলে অতীতে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, সামনেও সেটাই হবে। তিনি বলেন, অতীতের সার্চ কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যোগ্য ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সরকার যাদের চায়, সার্চ কমিটির সুপারিশে তাদের নামই আসে।
সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, সার্চ কমিটি বিতর্কিত হয়েছে। কমিটিতে যে নামগুলো আসে এর বাইরে যাওয়া যায় না।
অন্যদের মধ্যে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।