ইসি, পুলিশের ‘অভয়’, তবু শঙ্কা

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ৭৩৫ কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪২৯ কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যা মোট কেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ। মূলত আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল সোমবার থেকে নগরের বিভিন্ন জায়গায় টহল দেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। চট্টগ্রাম, ২৫ জানুয়ারিছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ৭৩৫ কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪২৯ কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যা মোট কেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ। মূলত আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। প্রচারণার ফাঁকে এলাকায় ফিরেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও। ফলে ভোটের দিন কেন্দ্রের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের পাশাপাশি শঙ্কায় আছেন বেশির ভাগ প্রার্থীও। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও পুলিশের ‘অভয়ে’ও স্বস্তি ফিরছে না।


রাত পোহালেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোট। কাল বুধবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ। মেয়র ও কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ২৩২ জন প্রার্থী। এবার ভোটারসংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬।


নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে পূর্ব বাকলিয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হন। আর এক প্রার্থী মারা যাওয়ায় বাতিল হয় আলকরণ ওয়ার্ডের ভোট। বাকি ৩৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ।
ওয়ার্ডগুলো হলো দক্ষিণ পাহাড়তলী, জালালাবাদ, চান্দগাঁও, পশ্চিম ষোলো শহর, উত্তর পাহাড়তলী, দক্ষিণ কাট্টলী, সরাইপাড়া, পাহাড়তলী, লালখান বাজার, চকবাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, পাঠানটুলী ও ফিরিঙ্গি বাজার ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকেরা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বক্তব্য দেন
ফাইল ছবি


কেন এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) চিহ্নিত করা হয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের সংঘাতের ইতিহাস, বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্ব ও  সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকবে। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন।
নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হবে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের জন্য দাবি জানিয়ে এলেও উদ্ধারের হার প্রায় শূন্য। আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।  
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা গত রোববার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে।’

এলাকায় ফিরছে সন্ত্রাসীরা


২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ত্রসহ র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নূর মোস্তফা ওরফে টিনু ১৮ জানুয়ারি জামিনে বেরিয়ে আসেন। গত মাসে জামিনে আসেন র‍্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার তালিকাভুক্ত আরেক সন্ত্রাসী সাইফুল আলম ওরফে লিমন। এর আগে এসেছেন এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা।

গণসংযোগ করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদত হোসেন।
ফাইল ছবি


২০১৯ সালে ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পরই চট্টগ্রামে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী গা ঢাকা দিয়েছেন। নির্বাচন ঘিরে তাঁরা এখন এলাকায় ফিরে এসেছেন।


সিআরবি জোড়া খুনের মামলার আসামি হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর নগরের লালখান বাজারে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষেও প্রচারণা চালান। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মহিউদ্দিন বায়েজীদ বোস্তামী শেরশাহ এলাকায়, সিআরবি এলাকার রিটু দাশ ওরফে বাবলু টাইগারপাসে ও জিইসি মোড়ে এবং আবদুর রউফ চকবাজার ও দেওয়ানবাজার এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় অংশ নেন। এহতেশামুল বিএনপির কোনো পদে না থাকলেও দলটি সমর্থিত প্রার্থীদের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন বাকলিয়া এলাকায়।

পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে ভোটের দিনে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ও আধিপত্য বিস্তারে প্রকাশ্যে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নির্বাচনে ব্যবহার হতে পারে।
আখতার কবির চৌধুরী, সম্পাদক, সুজন, চট্টগ্রাম


আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন সাইফুল আলম। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। তাই প্রচারণায় নেমেছি।’
নগর পুলিশ কমিশনার দাবি করেন, সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
শঙ্কায় ভোটার ও প্রার্থীরা


প্রচারণা শুরুর পাঁচ দিনের মাথায় ১২ জানুয়ারি পাঠানটুলীতে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক মহল্লা সরদার নিহত হন। এ ঘটনায় বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই এলাকায় ভোটাররা শঙ্কা কথা জানিয়েছেন। ওই এলাকার জাকির হোসেন ও মো. জুলহাস সরকারি কমার্স কলেজ কেন্দ্রের ভোটার। গত নির্বাচনে তাঁরা ভোট দিতে পারেননি, এবারও শঙ্কায় আছেন।

অতীতের সংঘাতের ইতিহাস, বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্ব ও সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকবে। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন।
সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, পুলিশ কমিশনার


পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরও অভিযোগ করে বলেন, তাঁর ওয়ার্ডে সন্ত্রাসীরা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
দক্ষিণ পাহাড়তলীর ১২টি কেন্দ্রের মধ্যে সব ঝুঁকিপূর্ণ। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শফিউল আজিম আশঙ্কা করেন, সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভোট দখল করতে পারে। ওয়ার্ডটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।


নির্বাচন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে ভোটের দিনে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ও আধিপত্য বিস্তারে প্রকাশ্য ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় নির্বাচনে ভাড়ায় ব্যবহার হতে পারে।