ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার প্রহর

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

এখন আমরা নির্বাচনী কাব্যগাথার তৃতীয় অধ্যায়ে এসে পৌঁছেছি। প্রথম অধ্যায় ছিল প্রচারণার আগ পর্যন্ত। তখন ভাবা হচ্ছিল নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে কি না, সেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না। এ বাস্তবতায় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার শর্ত গড়ে উঠেছিল।

এরপর এল দ্বিতীয় অধ্যায়, প্রচারণার সময়। সেখানে আমরা দেখলাম, চরম অসমতল নির্বাচনী একটি খেলার মাঠ। যেখানে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সার্বিকভাবে একটি দল ও জোটের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে।

প্রথম অধ্যায়ে যখন শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার আশা দেখা গিয়েছিল—তখনো অবশ্য প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ দেখানোর বাস্তবতা তৈরি হয়নি। কিছু কিছু পদক্ষেপ সে সময় আমাদের আশাবাদী করে তুলেছিল। দ্বিতীয় পর্বে, অর্থাৎ প্রচারণার সময় সে আশা ভেঙে গেল। প্রচারের নামে শুরু হলো মাঠ দখল। সরকারি দল ও জোটের বাইরে বিরোধীপক্ষ দারুণভাবে এ পর্যায়ে মার খেয়েছে। তারা প্রচারণায় নামতে পারেনি। প্রচারণার সময়কালে কিছু ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীরা আক্রান্ত হলেও সার্বিকভাবে চরম একপেশেভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা।

নির্বাচনী কাব্যগাথার তৃতীয় পর্বে এখন আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। অতীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তারপরও আমরা বলব, সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে আশা ব্যাহত হয়েছে, তৃতীয় অধ্যায়ে এসে আশার সেই জায়গা আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। এখন মূল বিষয় হচ্ছে ভোটাররা তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না, তারা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে কিংবা নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে যার যার পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবে কি না, ভোটের ফলাফল সুষ্ঠু হবে কি না। এসব প্রশ্নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 
৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসিসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের তিনটি প্রত্যাশা।

প্রথমত, একার যারা প্রথম ভোট দেবে, তাদের সংখ্যা ১ কোটি ২৩ লাখ। আর যদি ২২ থেকে ২৮ বছরের তরুণদের হিসাব করি, তাহলে প্রায় ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের ২২ শতাংশ হলেন তরুণ। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ কি না, বাংলাদেশের সম্মানজনক আত্মপরিচয় আছে কি না—প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তার সঙ্গে তরুণ এই ভোটারদের মোলাকাত হবে। এই মোলাকাত আশাব্যঞ্জক হবে নাকি ভেস্তে যাবে, এটিই প্রধান প্রশ্ন। এই বিশাল সংখ্যায় তরুণ ভোটাররা নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, সেটি দেখার বিষয়। কারণ, তারা ইতিমধ্যে একটি বিপরীত দৃশ্যপট দেখতে শুরু করেছেন। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ যাবৎ যত পক্ষপাতমূলক আচরণই করে থাকুন না কেন, এই তরুণ ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা অনুচিত হবে। তরুণ ভোটাররা যে রাষ্ট্রের মালিকানার অংশ, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সে বোধটা তাঁদের উপলব্ধি করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতা নিদারুণ হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর তার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে, তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগগুলো বায়বীয় নয়, সেগুলোর বাস্তব সত্যতা রয়েছে। ইসিসহ এসব বাহিনীর একপেশে আচরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে যদি ভুয়া ভোটের ঘটনা ঘটে, কেন্দ্র দখল হয় এবং ইসি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি তা থামাতে না পারে, তাহলে সেটি নির্বাচনী অপরাধ হয়ে যাবে।

একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক দায়িত্ব ইসির। ইসিকে এখন নিজেদের দিকে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের এখন নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার চূড়ান্ত প্রহর। কোনো সুনির্দিষ্ট দলের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর অবকাশ আর নেই। একপেশে পক্ষপাতমূলক আচরণ এখন হয়ে উঠবে নির্বাচনী অপরাধ। আমাদের প্রত্যাশা, কোনো নির্বাচনী অপরাধ তারা করবেন না।

তৃতীয়ত, আমাদের কিছু নির্বাচন-পরবর্তী প্রত্যাশাও রয়েছে। নির্বাচনের পর বাংলাদেশের গোটা উন্নয়নকাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আওয়ামী লীগ তাদের প্রচারণায় উন্নয়নের কথা বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কথা বলছে। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের আলোচনায় গণতন্ত্র বেশি এসেছে, উন্নয়ন ততটা আসেনি। উন্নয়নের চাকচিক্যময় পরিসংখ্যানের নিচে বহু ঝুঁকি জমে গেছে। তার বহু উদাহরণও আছে। এর অন্যতম হলো ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, ভয়াবহ বেকারত্ব, মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প প্রভৃতি। তা ছাড়া শুধু ব্যাংকিং খাতই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের দিকেও আমরা অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছি। অন্যদিকে আবার আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কমে গেছে।

সুবিধাভোগীদের কথা শুনে লাভ নেই। তাদের দৃষ্টিতে সবকিছুই সোনালি। একপেশে পরিসংখ্যান নিয়ে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। তাই ক্ষমতায় যারাই আসুক, তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে এ পর্যন্ত গড়ে ওঠা উন্নয়নের ধারা নিয়ে গভীরভাবে পুনর্চিন্তা করা। নির্বাচনের পর উন্নয়নের পথে কোন দৃষ্টিতে কোন পথে বাংলাদেশ হাঁটবে, সেটা দেখার প্রত্যাশা রইল।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা