ঈদের আনন্দই মাটি করে দিল...

তিনি একজন তরুণ চিকিৎসক (২৮)। বিয়ে করেছেন কয়েক দিন আগে। আশা ছিল, এবারের ঈদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে অনেক আনন্দ করবেন। কিন্তু করোনা তাঁর সব পরিকল্পনা ওলটপালট করে দিয়েছে। গত শনিবার জানতে পারলেন কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এরপর থেকে বাড়ির একটি কক্ষে আইসোলেশনে আছেন। পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা নেই। ঈদের আগে এমন ঘটনা ঘটায় গোটা পরিবারই এখন উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া ওই চিকিৎসক চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। তাঁর বাড়ি উপজেলার কলাদী এলাকায়। তাঁর মতো কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ৬৮ জন এবং করোনায় মারা যাওয়া আট ব্যক্তির পরিবারে এবারের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। গত দুই দিন কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ১০-১২ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এই করুণ অবস্থার কথা জানা গেছে।

মো. আনিসুজ্জামান চৌধুরী (৬৫) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ৯ জুলাই ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে গোটা পরিবারেই নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শোকে মুষড়ে পড়া তাঁর পরিবারের সদস্যদের চোখে-মুখে হতাশা ও দুশ্চিন্তার ছাপ। কথা হয় তাঁর ছোট ভাই কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনা আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে। আমরা পাগলপ্রায়। সংসারের অবস্থাও খারাপ। আগামী দিনে কীভাবে চলব বুঝতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাবছিলাম, ভাইকে নিয়ে এবার ভালো করে ঈদটা করব। আনন্দ করব। কিন্তু করোনায় আমাদের পরিবারের ঈদের আনন্দ মাটি করে দিল।’

গত ১৩ জুন উপজেলার উপাদী এলাকার এক পাটকলশ্রমিক (৫৩) করোনার উপসর্গ নিয়ে নিজ বাড়িতে মারা যান। পরে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে তাঁর করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। পরিবার জানায়, ওই ব্যক্তিই ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। তাঁর সামান্য আয়েই চলত সংসার। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘করোনায় আমার স্বামীকে কাইড়া নিছে। লগে আমাগো কপালও পুড়ছে। উনি মারা যাওয়ায় এখন আমাদের সামনে শুধু অন্ধকার। ঈদের আনন্দ তো দূরের কথা, সেমাইটুকুও কেনা অয় নাই। শোক আর অভাব নিয়া ক্যামনে আনন্দ করুম।’

গত ১১ জুন উপজেলার উপাদী উত্তর ইউনিয়নের এক মুক্তিযোদ্ধা (৬৫) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে পরিবারে মাতম চলছে। ওই পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘আশা আছিল, এবার কোরবানির ঈদে অনেক মজা করুম (করব) । কিন্তু করোনায় আমাগো সেই আনন্দে পানি ঢাইলা দিছে।’

গত ২০ জুন করোনায় মারা যান উপাদী দক্ষিণ এলাকার এক কৃষক (৪০)। ওই কৃষকের স্ত্রী বলেন, ‘টুকটাক কাজ কইরা আমার স্বামী যা পাইতেন, তা দিয়াই খাইয়া না-খাইয়া থাকতাম। করোনায় উনি মারা যাওনের পর হেইডাও বন্ধ অইয়া গেল। দুই দিন পর ঈদ। টেয়াপয়সা কিচ্ছু নাই। ঈদের সেমাইও কিনতে পারি নাই অহনতক। করোনায় উনি মারা গেছেন, মাইরা গেছে আমাগোও।’

মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যালয় সূত্র জানায়, এ উপজেলায় গত ১২ মে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। আজ বুধবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১৭২। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১০৩ জন। বাকি ৬৯ জন এখনো সুস্থ হননি। বাসায় আইসোলেশনে থেকে করোনার সঙ্গে লড়াই করছেন তাঁরা। তাঁদের বাড়ি লকডাউন করে রাখা হয়েছে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন হোম কোয়ারেন্টিনে।