ঈদের ছুটিতে সড়কে ঝরল ৬৫ প্রাণ

  • সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ঈদের পরের দিন—বুধবার। দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২৩ জন নিহত হন।

  • নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণ।

ঈদের ছুটিতে সড়কে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৪৮ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। গতকাল সকালেও পাবনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন দুজন। তবু ফিরছে না সচেতনতা। বেলা আড়াইটায় পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কের লস্করপুর বাইপাস এলাকায়
ছবি: হাসান মাহমুদ

বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে কেটেছে বিগত দুই বছরের ঈদগুলো। এবার করোনার সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই ঈদ উদ্‌যাপনে ছিল না কোনো ধরনের বিধিনিষেধ। যাঁর যাঁর মতো সবাই আনন্দে মেতেছেন। নির্বিঘ্ন ঈদ উদ্‌যাপনের মধ্যে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। ঈদ উপলক্ষে পাঁচ দিনের ছোটাছুটির মধ্যে সড়কে প্রাণ গেছে অন্তত ৬৫ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। গত পাঁচ দিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন।

ঈদযাত্রার চেয়ে এবার ঈদে বেড়াতে বেরিয়ে সড়কে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ঈদের পরের দিন—বুধবার। ওই দিন দুর্ঘটনায় সারা দেশে কমপক্ষে ২৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সী কিশোর ও তরুণ। আর গতকাল বৃহস্পতিবার রাত নয়টা পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

সড়কে পাঁচ দিনে নিহত ৬৫ জনের মধ্যে ৩১ জনই (৪৮ শতাংশ) ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহী।

বেশি মৃত্যু ঈদের পরের দিন

ঈদের ছুটি শুরু হয় ১ মে থেকে। অন্যবারের চেয়ে স্বস্তি ছিল এবারের ঈদযাত্রায়। মহাসড়কগুলোতে তেমন কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। ছুটি শুরুর দিন সড়কে তেমন প্রাণ ঝরেনি। ছুটির প্রথম দুই দিনে অর্থাৎ গত রোববার ও সোমবার সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন করে নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই দুই দিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে বাগেরহাটের ফকিরহাটে রোববার সকাল পৌনে নয়টার দিকে। যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। আহত হন ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বাস ও ট্রাকের দুই চালক এবং ১০ মাস বয়সী এক শিশু ছিল।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা এক লাফে ১৩ জনে দাঁড়ায় ঈদের দিন—মঙ্গলবার। এদিন দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওই দিন গাজীপুরে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজনের প্রাণ যায়। বিকেল চারটার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর উড়ালসড়কের পূর্ব পাশে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাস এবং এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তাঁরা নিহত হন। এর মধ্যে দুজন নারী ছিলেন।

ঈদের পরের দিন বুধবার বেড়ে যায় মানুষের বেড়ানো আর ছোটাছুটি। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ে সড়কে প্রাণহানিও। সড়কগুলোতে ওই দিন ২৩ জন নিহত হন। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে স্বামী–স্ত্রীসহ পাঁচজন নিহত হন।

বিকেল চারটায় পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের পুকুরীরডাঙ্গা-বালুরঘাট এলাকায় তালমা-মডেলহাট সড়কে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের গাছের সঙ্গে ধাক্কায় তিন কিশোর নিহত হয়। তারা উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জিয়াবাড়ি-খালপাড়া এলাকার মাহবুবার রহমান (১৭), আবু বক্কর সিদ্দিক (১৬) ও নতুন ইসলাম (১৬)। তিনজনই একই মোটরসাইকেলে ছিলেন।

বুধবার দুপুরে কুষ্টিয়ার খোকসায় পিকআপ ভ্যান ও থ্রি-হুইলারের সংঘর্ষে দুই ভাই নিহত হন। নিহত দুজন হলেন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার কলিমহর গ্রামের রেজাউল ইসলামের ছেলে ফিরোজ মণ্ডল (৪৫) ও সামিরুল ইসলাম (১০)। ওই দিন সকালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস উল্টে দুই যাত্রী নিহত হন।

ঈদ উদ্‌যাপনের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক ছিল গতকাল বৃহস্পতিবারও। গতকাল রাত নয়টা পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯। দুজন করে মৃত্যু হয়েছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া, চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়ক ও নারায়ণগঞ্জে।

অর্ধেক মৃত্যু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

ঈদ উদ্‌যাপনের মধ্যে এখন পর্যন্ত যেসব মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মৃত্যুই ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সড়কে পাঁচ দিনে নিহত ৬৫ জনের মধ্যে ৩১ জনই ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহী। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৪৮ শতাংশই ছিলেন হয় মোটরসাইকেলের চালক, নয়তো আরোহী। মোটরসাইকেলের এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুরসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলায়।

এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের পুকুরীরডাঙ্গা-বালুরঘাট এলাকায় তালমা-মডেলহাট সড়কে। ঈদের পরের দিন মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল তিন কিশোর। পথে তাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য আরেকটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মোটরসাইকেলসহ তারা সড়কের পাশের একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাদের তিনজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত তিন কিশোর হলো হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জিয়াবাড়ি-খালপাড়া এলাকার তারেক বিল্লাহর ছেলে মাহবুবার রহমান (১৭), আব্বাস আলীর ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (১৬) ও পয়গাম আলীর ছেলে নতুন ইসলাম (১৬)।

পঞ্চগড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য মূলত অভিভাবকদের অসচেতনতা, স্কুল-কলেজেপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দেওয়াটাই দায়ী। সড়ক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী মোটরসাইকেলচালককে অবশ্যই ১৮ বছরের বেশি বয়স হতে হবে। সেখানে সন্তানের আবদার মেটাতে অভিভাবকেরা কম বয়সী ছেলেদের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দিচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।

ঈদের দিন সিরাজগঞ্জের তাড়াশে পৃথক দুটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই বন্ধুসহ তিনজন নিহত হন। সন্ধ্যায় তাড়াশ-রাণীনগর আঞ্চলিক সড়কের পেঙ্গুয়ারী মোড়ে ধোপাগাড়ি ব্রিজ এলাকায় তিন বন্ধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েন। এতে দুজন মারা যান। তাঁরা হলেন উপজেলার তালম ইউনিয়নের বড়ইচড়া গ্রামের আবু বক্কারের ছেলে মেহেদী হাসান ও জালাল উদ্দিনের ছেলে রাকিব হোসেন। এর আগে বিকেলে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে উপজেলার মান্নাননগর এলাকার ৯ নম্বর সেতুর কাছে বেপরোয়া গতির একটি মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হয় শাকিল আহমেদ নামের এক কিশোর।

ঈদের দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন তিন বন্ধু। বাড়ি ফেরার আগেই সেতুর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রাণ হারান তাঁরা। ওই দিন বিকেলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কুঁইচামারা সেতুর কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে।