ঈশ্বরদীতে পাঁচ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর আত্মসমর্পণ

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন ঈশ্বরদীর কাহিনি

পাবনার ঈশ্বরদীতে পাঁচটি স্থানে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বরের পর স্থানীয় লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাকিস্তানিরা সেই ঘাঁটিগুলোতে কার্যত অবরুদ্ধ ছিল। পাঁচ দিন পর ২১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা। ওই দিনই এক হাজার পাকিস্তানি সেনা গাড়িতে সাদা পতাকা উড়িয়ে ঈশ্বরদী ছাড়ে।
স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করেছিল পাবনার নগরবাড়ী হয়ে। দিনটা ছিল ১১ এপ্রিল। ওই দিন দুপুরে ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এরপর বেশ কয়েকটি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ হয়েছে এখানে। এগুলোর কয়েকটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন মুজিব বাহিনীর থানা আঞ্চলিক প্রধান নূরুজ্জামান বিশ্বাস।

নূরুজ্জামান বলেন, সে সময় ঈশ্বরদী শহরে কয়েক হাজার বিহারি ছিল। তারা ফতেমোহাম্মদপুর, আলহাজ কলোনি ও ঈশ্বরদীর এয়ারপোর্ট এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এই বিহারি ও রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদারেরা ঈশ্বরদীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর এখানে অবস্থানরত সেনারা ভয় পেয়ে যায়। ঈশ্বরদীর জয়নগর ওয়াপদা, বর্তমানে বাংলাদেশ সুগারক্রপ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ, ঈশ্বরদী এয়ারপোর্ট ও পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় পাকিস্তানিরা খণ্ড খণ্ডভাবে অবস্থান করছিল। বিজয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপর পাকিস্তানি সেনারা ভয়ে বর্তমান সুগারক্রপ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ১৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরদীতে ওড়ানো হয় বিজয়ের পতাকা। তবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল তারও দুই দিন পর।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান বললেন, পাকিস্তানি সেনারা যখন সুগারক্রপ ইনস্টিটিউটে অবস্থান করছিল, তখন কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা এলাকাটি ঘিরে ফেলেন। এতে নেতৃত্বে দেন মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম, নূরুজ্জামান বিশ্বাস, নায়েব আলী বিশ্বাস, আজমল হক বিশ্বাস, প্রয়াত আনিছুর রহমান প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা বাইরে থেকে বারবার খবর পাঠিয়ে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু পাকিস্তানিরা ভয়ে রাজি হচ্ছিল না। ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা তখন ঈশ্বরদী শহরে। শেষে ২১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর আহমেদ ঈশ্বরদীতে আসেন। তিনি এসে আত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দেন। এরপর মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিংয়ের উপস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানিরা।
ঈশ্বরদীতে আত্মসমর্পণের প্রায় একই বর্ণনা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, লেখক সি এম তারেক রেজা। তাঁর লেখা একাত্তর: বিজয়ের সেই ক্ষণ বইটিতে উল্লেখ আছে, ‘যশোর অঞ্চল থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে পালিয়ে আসা পাকিস্তানি ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের মঞ্জুর আহমেদের নেতৃত্বে ঈশ্বরদীতে ২১ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ১৬৫ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে।’

সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধারা যেমন সাহসী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন, তেমনি জেনেভা কনভেনশনও মেনে চলেছেন। তাই পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের পর যখন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ঈশ্বরদী ছাড়ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধপরায়ণ হননি। যদিও ঈশ্বরদীতে বিহারি ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। অনেক বাঙালিকে হত্যার পর মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। কবরও দিতে দেয়নি।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি মাহাবুবুল হক}