উত্তরণে চাই সমন্বিত পদক্ষেপ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে পোশাক খাতকে পুনরুদ্ধারে সরকার, কারখানা মালিক, শ্রমিক এবং ক্রেতা দেশগুলোকে নিয়ে সমাধানের পথ বের করতে হবে।

সিপিডির আয়োজনে শনিবার ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত হয় ‘কোভিড-১৯ সংকট থেকে পোশাক খাতের পুনরুদ্ধার: সরবরাহ ব্যবস্থা ভিত্তিক সমাধান কি সম্ভব?’ শীর্ষক সংলাপ
ছবি: সিপিডির ফেসবুক থেকে নেওয়া

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় নতুন করে সংকটে পড়েছে তৈরি পোশাক খাত। সংকট থেকে উত্তরণে সরকার, কারখানামালিক, শ্রমিক, ক্রেতা এবং ক্রেতা দেশগুলোর সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। বিদেশি ক্রেতাদের পোশাকের দাম কমিয়ে দেওয়াও চলবে না। এ ব্যাপারে পোশাক আমদানিকারক দেশের সরকারগুলোও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে গতকাল শনিবার ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত ‘কোভিড-১৯ সংকট থেকে পোশাক খাতের পুনরুদ্ধার: সরবরাহ ব্যবস্থা ভিত্তিক সমাধান কি সম্ভব?’ শীর্ষক সংলাপে এমন পরামর্শ উঠে এসেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রমসচিব কে এম আবদুস সালাম এবং ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারভেইজ। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক এবং শ্রমিক অধিকারকর্মী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সম্মানিত অতিথি।

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আর স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি কমে যায় ২৩ শতাংশ। কোভিড-১৯-এর কারণে ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য স্তূপ হতে থাকে। ক্রেতারা পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে বিল আটকে রেখেছেন। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা তারপরও ক্রয়াদেশ নিয়েছেন, যেহেতু কোনো বিকল্প ছিল না।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় পোশাক খাতের জন্য সরকারি উদ্যোগগুলো কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। যদিও সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছিল ছাঁটাই যাতে না করা হয়। এটা মানা হয়নি। এই সময়ে শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮ শতাংশ, আর তাঁদের ওপর চাপ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। তবে গত এপ্রিলে যে অনিশ্চয়তা ছিল ৩৬ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা নেমে আসে ৪ শতাংশে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মোকাবিলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। পাশাপাশি আমাদের নতুন বাজার খুঁজতে হবে। চীন-ভারতের মতো বড় বাজারগুলোতে ঢুকতে পারলেও বিপদ কমবে।’

বিদেশি ক্রেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, ক্রেতারা যদি পোশাকের ক্রয়াদেশ ঠিক রাখেন আর মূল্য কিছুটা বাড়িয়ে দেন, এ খাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এ খাতের জন্য সরকারের দেওয়া ঋণ সহযোগিতার সময় আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান শ্রমিকদের জন্য ক্ষুদ্র বিমা চালু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চান, ক্রেতা হিসেবে তাঁর কোম্পানি কোনো দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী কি না।

জবাবে জিয়াউর রহমান বলেন, এইচঅ্যান্ডএম এই সংকট দূর করতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। সংকট মোকাবিলায় সরকার, মালিক, ক্রেতা ও শ্রমিক নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে অবশ্যই এইচঅ্যান্ডএম পোশাকের মূল্য কিছুটা বাড়াতে রাজি।

নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারভেইজ বলেন, কোনো সরকার কোনো কোম্পানিকে সরাসরি নির্দেশনা দিতে পারে না। তবে নেদারল্যান্ডস সরকার সে দেশের পোশাক আমদানিকারকদের বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার আদেশ বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘আমরা এখন দ্বিতীয় সংকটে পড়েছি। এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে।’

নির্ধারিত আলোচক ন্যাশনাল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, কয়েক লাখ ছোট কারখানা আছে দেশে। এগুলোতে মজুরি কমে গেছে। কমে গেছে ওভারটাইম। উল্টো বেড়ে গেছে সবকিছুর দাম।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, এই দুঃসময়ে শুধু শ্রমিকেরা নন, মালিকেরাও অসহায়। ক্রয়াদেশ বাতিল ও মূল্য কমিয়ে দেওয়ায় মালিকদের চুপ করে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। মহামারির এই সময়ে মালিক ও ক্রেতারা হয়তো মুনাফার একটি অংশ হারাবেন, শ্রমিকদের কিন্তু চাকরি না থাকা মানে খাবার না থাকা।

কল্পনা আক্তার আরও বলেন, একজন ক্রেতাকে তো আর বলা যায় না তিনি সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু করুন। এ কাজ সরকারকেই করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রমসচিব কে এম আবদুস সালাম বলেন, ‘শ্রমিক ছাঁটাই’ দুটি মর্মান্তিক শব্দ। বর্তমান মানবিক সরকার তা চায় না। এ কারণেই কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছে পোশাক খাতকে। এই মুহূর্তে মালিক-শ্রমিকের কোনো দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিও সরকার আশা করে না।