উত্তরবঙ্গে তথ্য চেয়ে আবেদন বেশি

দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘তথ্য আমার অধিকার জানা আছে কি সবার’।

প্রতীকী ছবি

তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে শহরের মানুষ বেশি জানে। কিন্তু এ আইনে আবেদন বেশি করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলা থেকে তথ্য চেয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয়। এ ছাড়া বিভাগের দিক থেকে এগিয়ে রংপুর। তথ্য কমিশনের গত চার বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গণমাধ্যমবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এমআরডিআই) জাতীয় তথ্য অধিকার জরিপ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা আইনটি সম্পর্কে জানেন, তাঁদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে আবেদনের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহরে ১ দশমিক ৯ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলেছেন, উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে তথ্য অধিকার বিষয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম তুলনামূলক বেশি। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষজনও জীবনঘনিষ্ঠ নানা তথ্যের জন্য আবেদন করেন। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে দ্রুত তথ্য দিতে না চাওয়ার প্রবণতা থেকেও আবেদন করা হয়।

মানুষের জন্য একটি আইন হয়েছে, কিন্তু ব্যবহার কম হচ্ছে। স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও পড়তে হবে এবং জানতে হবে।
মোহাম্মদ জমির, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

জানতে চাইলে তথ্য কমিশনার সুরাইয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরাঞ্চলে প্রান্তিক মানুষ তুলনামূলক বেশি। তাদের সমস্যাও বেশি হতে পারে। সেই চাহিদা থেকেই তারা আবেদন করে।

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘তথ্য আমার অধিকার জানা আছে কি সবার’।

তথ্য কমিশনের ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য, সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয় নীলফামারী থেকে। এই চার বছরে ২ হাজার ১৪০টি আবেদন করা হয়। গত চার বছরে রংপুর বিভাগে ৪ হাজার ২২০টি আবেদন করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ে কৃষিতে। চার বছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৩১০টি আবেদন পড়ে।

নীলফামারীর সমাজকর্মী তুতিয়া হরিজন পারিবারিক ও সামাজিক ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন। আবেদন করে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি জানতে পারেন। দিনাজপুরের গৃহিণী মারুফা বেগম তাঁর এলাকার শতবর্ষী গাছ কেন কাটা হচ্ছে তা জানতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। একই জেলার ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলামও পুলিশের কাছে আবেদন করে জানেন যে প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে হয়রানি করে করলে নাগরিকের কী করণীয়। তুতিয়া, মারুফা এবং হামিদুল তিনজনই বেসরকারি সংস্থা থেকে তথ্য অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।

তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের তথ্য অধিকারবিষয়ক প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর রুহী নাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, তথ্য অধিকার আইন করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন হয়েছে। এমনও মানুষ আছে, যারা কোনো একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতেও সংকোচ বোধ করত। সেই জায়গা থেকে উঠে এসে এখন তারা নিজেদের কথা বলছে, তথ্য চাইছে।’

নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি জানালেন, জেলা প্রশাসনের লাইব্রেরিতে নির্দিষ্ট একটি বই আছে কি না, সে তথ্য জানতে চাইলেও তাঁকে আবেদন করতে বলা হয়। এ ছাড়া সাধারণ কোনো তথ্য চাইলেও সরকারি কর্মকর্তারা দিতে চান না বা ভয় পান। সে ক্ষেত্রে আবেদন করতে হয়।

এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে নিজের সমস্যার সমাধান করে নিতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের ঝক্কিতে তাদের যাওয়ার প্রবণতা কম। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় এবং এনজিওগুলো তথ্য অধিকার আইন তাদের সামনে নিয়ে যায়, তখন তারা আবেদন করে। এই মানুষেরা জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো নিয়েই বেশি আবেদন করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ারও এটি একটি কারণ।

আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা

তথ্য কমিশনে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৭৪টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয় ২ হাজার ১৫৬টি অভিযোগ। অভিযোগকারীদের মধ্যে সাধারণ মানুষই বেশি। এরপরে আছে সাংবাদিক। অভিযোগকারীদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষ বেশি।

এমআরডিআইয়ের জাতীয় তথ্য অধিকার জরিপ ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে সচেতনতা কম। জাতীয়ভাবে মাত্র ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। জেলা হিসেবে মুন্সিগঞ্জের মানুষ তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে বেশি সচেতন—১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম মেহেরপুরে—শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

তথ্য কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, আবেদনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথ্য দেবেন কি না, তা জানার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নির্দেশনা চান। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথ্য দিয়ে বিপদে পড়তে পারেন সে আশঙ্কায় থাকেন। অনেক কর্মকর্তার স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের নির্দেশিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমির প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মানুষ জমিজমা এবং কৃষিবিষয়ক বিষয়গুলো নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকে। সে চাহিদা থেকেই তারা তথ্য চায়। তিনি বলেন, মানুষের জন্য একটি আইন হয়েছে, কিন্তু ব্যবহার কম হচ্ছে। স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও পড়তে হবে এবং জানতে হবে।