উদ্বেগ বেশি কর্মসংস্থান নিয়ে

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সেভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এ অবস্থায় দেশের প্রায় ৭৮ শতাংশ তরুণ নিজেদের কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এ উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি।

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ অনুযায়ী, ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের এবং অছাত্রদের চেয়ে ছাত্রদের মধ্যে উদ্বেগ বেশি। আর জরিপে অংশ নেওয়া উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রায় ৯১ শতাংশই ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন।

তবে কর্মসংস্থান নিয়ে সার্বিকভাবে উদ্বেগ দুই বছর আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১৭ সালের জরিপে ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, যা এবার ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

এবারের জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৫ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন, দিনে দিনে বেকারত্ব বাড়ছে। বেকারত্ব বাড়ছে, এ ধারণা উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারী স্নাতক পাস বা এর বেশি শিক্ষিতদের প্রায় ৯৮ শতাংশই মনে করেন, বেকারত্ব বাড়ছে। তবে সার্বিকভাবে বেকারত্ব বাড়ছে—এমন ধারণা দুই বছর আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। দুই বছর আগে প্রায় ৯৩ শতাংশ তরুণ মনে করতেন বেকারত্ব বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুযায়ী, মজুরির বিনিময়ে সপ্তাহে এক ঘণ্টার কম কাজের সুযোগ পান, এমন মানুষকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেকার চার লাখের বেশি।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রকাশিত ‘স্টাডি অন এমপ্লয়মেন্ট, প্রোডাক্টিভিটি অ্যান্ড সেক্টরাল ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ছদ্মবেকারের সংখ্যা সোয়া কোটি। যেসব তরুণ-তরুণী (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) কাজের মধ্যে নেই, আবার পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণেও নেই, তাঁদের ছদ্মবেকার বলা হচ্ছে। জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

প্রথম আলোর এবারের জরিপে ৬ জন বিশেষজ্ঞ এবং ১৪ জন তরুণের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। গুণগত এই সমীক্ষায় অংশ নিয়ে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চাকরি পাওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেগুলোর ঘাটতি রয়েছে। তাঁরা বলছেন, দেশের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার চেয়ে সনদের গুরুত্ব বেশি। মুষ্টিমেয় যে কটি খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে, তাদের পক্ষে এত কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব নয়। দেশে কোন ধরনের দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, সেটি নির্ধারণে জরিপ পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ধারণা, চার-পাঁচ বছর পড়ালেখা করার পরে তাঁরা একটি সনদ পাবেন আর এই শিক্ষাসনদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁদের চাকরি দেবে। কিন্তু চাকরির বাজার কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, সে বিষয়ে তাঁদের ধারণা নেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি চাকরির জন্য যথেষ্ট নয়। চাকরি পাওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা-দক্ষতা প্রয়োজন, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সেগুলোর ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতা বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও তরুণদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। অথচ উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাকরি পেতে ও প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে তরুণদের কিছু দক্ষতার প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও উদ্ভাবনী দক্ষতা বা সফট স্কিল, ভাষার দক্ষতা ও কারিগরি দক্ষতা ইত্যাদি। পেশাগত জীবনে এসব দক্ষতা দরকার। এ ধরনের দক্ষতা বাড়াতে উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত মূলধন না থাকায় তরুণদের পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়াও কঠিন। আবার শিক্ষিত তরুণেরা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পান না, বিষয়ভিত্তিক চাকরি পান না।

বেকারত্বের নানামুখী প্রভাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বেকারত্ব থেকে তরুণদের মধ্যে হতাশা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটানো, মাদকাসক্তি, অপরাধ ও সহিংসতার মতো ঘটনার বিস্তার হতে পারে। বেকারত্ব তরুণদের অপরাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, দলীয় ক্যাডার, গোপন হত্যা ও গুমের মতো ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাধা কোথায়

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষকে বেকারত্ব বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করছেন জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোশাক কারখানাগুলোতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে উৎপাদন বাড়লেও চাকরির সুযোগ কমেছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা রাখছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি খাত। রপ্তানি আয়ের তৈরি ৮০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের পক্ষে এককভাবে বা মুষ্টিমেয় কয়েকটি খাতের পক্ষে এই তরুণদের কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব নয়। আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে অন্যান্য খাতের উন্নয়ন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু অসহায়ক নীতিমালা ও কঠিন শর্তাবলিসহ নানা বিষয় উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি

বিদেশে কাজের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বিদেশি ভাষা বলতে শুধু ইংরেজি নয়, অন্য ভাষাও শেখা যেতে পারে। যেমন ১৪টি খাতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে সম্প্রতি জাপানের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এসব কাজ করতে জাপানে যেতে চাইলে জাপানি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তেমনি আরবি, চীনা ভাষা শেখা তরুণদের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কী কী দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে সরকার বিদেশনির্ভর কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এ উদ্যোগ সফল হয় তাহলে বিদেশি আয়ের ক্ষেত্রে সুফল পাবে। যদিও সরকারের দেওয়া প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তরুণদের চাওয়া

জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের চাওয়া হচ্ছে, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব দূর এবং যোগ্যতা ও মানের ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা ঢাকা থেকে অন্যান্য বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণ ও কোটাব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। কারিগরি প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে হবে।

একই সঙ্গে কোন ধরনের চাকরির জন্য কেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা দরকার, সেটা পৃথক করা, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাপ্তাহিক কর্মদিবস ছয় দিনের বদলে পাঁচ দিন করা, কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সমুদ্র অর্থনীতিকে (ব্লু ইকোনমি) গুরুত্ব দেওয়া এবং সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানোর কথা বলেছেন তরুণেরা।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

বিশেষজ্ঞরা সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি কোম্পানি ও চাকরিদাতা, চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থী প্রত্যেকের জন্যই আলাদাভাবে কিছু সুপারিশ করেছেন।

দেশে কোন ধরনের দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, সেটি নির্ধারণে সরকারকে জরিপ পরিচালনা করতে হবে। জরিপের তথ্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের জানিয়ে সে অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বেকারত্ব ঘোচাতে ইতিমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শিক্ষা খাতের দুর্নীতি দূর এবং গুণগত শিক্ষা দেবে—এমন একটি উদার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।