উদ্ভাবনে একটুও উন্নতি নেই বাংলাদেশের

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ডব্লিউআইপিও গত সপ্তাহে উদ্ভাবন সূচক প্রকাশ করে।
ছবি: ডব্লিউআইপিও

প্রতিবেশীদের তুলনায় এখনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থা প্রায় তলানিতে। বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) উদ্ভাবন সূচকে তিন বছর ধরেই বাংলাদেশের কোনো উন্নতি নেই। চলতি বছর প্রকাশিত সূচকে বিশ্বের ১৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। এর আগের দুই বছরেও একই অবস্থান ছিল।

সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যদের তুলনায় বেশ এগিয়ে ভারত। দেশটির অবস্থান ৪৮তম। এই তালিকায় নেপাল ৯৫, শ্রীলঙ্কা ১০১ ও পাকিস্তান ১০৭তম অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ডব্লিউআইপিও গত সপ্তাহে উদ্ভাবন সূচক প্রকাশ করে। এতে সেরা দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে সুইজারল্যান্ড। এরপর রয়েছে সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে সিঙ্গাপুর। এরপরই দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, জাপান ও চীন। আর সবার পেছনে রয়েছে ইয়েমেন। বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের অবস্থানও অনেক পেছনে, ১২৯তম।

ডব্লিউআইপিও উদ্ভাবন সূচক প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। বিশ্ব অর্থনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি দেশের সবল দিক ও ঘাটতি তুলে ধরতেই এ প্রতিবেদন।

ডব্লিউআইপিও একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, মানবসম্পদ ও গবেষণা, অবকাঠামো, উন্নত বাজারব্যবস্থা, ব্যবসার পরিস্থিতি, জ্ঞান–প্রযুক্তিগত ও সৃজনশীল দিকের ওপর ভিত্তি করে সূচকটি তৈরি করে। এর অধীনে আবার নানা বিষয় আসে। তথ্য সংগ্রহ করা হয় সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে।

সাতটি উপসূচকের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো অবকাঠামোর দিক দিয়ে, বৈশ্বিক অবস্থান ৯২তম। এ সূচকের কয়েকটি ভিত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। যেমন জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে জ্বালানি ব্যবহার, মূলধন গঠন ও সরকারের অনলাইন সেবা। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ ও সেই সুযোগ পাওয়ার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েই রয়েছে।

জ্ঞান ও প্রযুক্তি উপসূচকের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জার্নালে প্রকাশিত লেখা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫তম।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অনেক প্রকল্প দেশে দৃশ্যমান। সেগুলো থেকে নিত্যনতুন উদ্ভাবনও চলছে। কিন্তু বড় দুর্বলতার জায়গা হলো উদ্ভাবনগুলোর মেধাস্বত্ব না নেওয়া। তিনি বলেন, ‘মেধাস্বত্ববিষয়ক যে আইনটি আছে, সেটি অনেক পুরোনো। আইন হালনাগাদ করে উদ্ভাবনকে আন্তর্জাতিকভাবে নথিভুক্ত করলে ওই সূচকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।’

মানবসম্পদ ও গবেষণা এবং বাজার ও বাণিজ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। মানবসম্পদে ১৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ উদ্ভাবনের পেছনে বিনিয়োগে পিছিয়ে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে অবস্থান, তার চেয়ে মেধাস্বত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।

মেধাস্বত্ব গবেষক ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা আমাদের গ্রামের নির্বাহী পরিচালক রেজা সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে সরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ নিয়ে উদ্ভাবন ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে। তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। যার সুফল নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অবকাঠামো দিয়ে উদ্ভাবনের পথে বেশি দূর এগোনো যাবে না। আমাদের দক্ষ জনবল তৈরি ও গবেষণায় বিনিয়োগ ও উদ্যোগ বাড়াতে হবে।’

২০১০ সালে সরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ নিয়ে উদ্ভাবন ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে।
রেজা সেলিম, মেধাস্বত্ব গবেষক ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা আমাদের গ্রামের নির্বাহী পরিচালক

প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক পরিবেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে ১১০তম ও কার্যকর সরকারের দিক দিয়ে ১১৭তম অবস্থানে রয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষাগত দিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প যৌথ উদ্যোগের গবেষণার দিক দিয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে সরকারের পেটেন্ট ও কপিরাইট জাতীয় কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য ও গবেষক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিবন্ধনের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার আগ্রহ নেই। আর উদ্ভাবনে কেউ বিনিয়োগও করতে চায় না। ফলে উদ্ভাবন করার ইচ্ছাও এখানে কম। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে উদ্ভাবনকে একটি জাতীয় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিবন্ধনের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার আগ্রহ নেই। আর উদ্ভাবনে কেউ বিনিয়োগও করতে চায় না। ফলে উদ্ভাবন করার ইচ্ছাও এখানে কম।
নুরুল হুদা, সরকারের পেটেন্ট ও কপিরাইট জাতীয় কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য ও গবেষক