উন্নত কর্মসংস্থান পেলে ৯৯% অভিবাসীপ্রত্যাশী দেশে থাকবেন: আইওএম

‘দেশে আমি যা উপার্জন করি, তা দিয়ে ভালোমতো জীবন চালাতে পারি না। বিদেশে গিয়ে অনেকেই ভালো করছে, তাই আমিও বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অভিবাসনে ইচ্ছুক একজন কর্মীর বক্তব্য এটি। তাঁর মতোই বলছেন প্রায় সব অভিবাসনপ্রত্যাশী। ৯৯ শতাংশই বলছেন, উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তাঁরা বাংলাদেশে থাকবেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ: সার্ভে অন ড্রাইভারস অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস প্রোফাইল’ নামের প্রতিবেদনটি আজ বুধবার একটি অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করে জাতিসংঘের এই অভিবাসন সংস্থা।

আইওএম বলছে, পাঁচটি প্রধান কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে অভিবাসন করেন। এগুলো হচ্ছে জীবিকার অভাব (বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে), অপর্যাপ্ত উপার্জন, অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সেবার অভাব এবং সীমিত সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা। প্রতিবেদনটি কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী চিত্র তুলে ধরলেও মহামারিকালীন অভিবাসনকে বুঝতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গবেষণায় অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৩৮ শতাংশ বলেছে, আইনের উন্নতি হলে তাঁরা দেশে থাকবেন।

সে ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা ও ২৯ শতাংশ আরও সুলভ স্বাস্থ্যসেবার কথা উল্লেখ করেছেন। আর প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী জানান, পড়াশোনার ক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়তা করা হলে তাঁরা দেশে থাকবেন। ২০১৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ১১ হাজার ৪১৫ জন সম্ভাব্য অভিবাসনপ্রত্যাশীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে আইওএম। এ বছরের জুনের মধ্যে অভিবাসনের ইচ্ছা জানিয়েছিলেন তাঁরা।

দেশে প্রথম ৬৪ জেলার ওপর এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হলো। এর আগে বাংলাদেশে অভিবাসনের চলনশক্তির ওপর পরিচালিত গবেষণা ছিল পরিসর এবং মাত্রার দিক দিয়ে নির্দিষ্ট ও সীমিত। সরকারি নিবন্ধনের ভিত্তিতে অভিবাসীদের নিয়মিত ও অনিয়মিত দুই খাতে ভাগ করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা পুরুষ এবং অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ২৭। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশের বয়স ২০–এর কোটায়। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই বিবাহিত। বেশির ভাগ উত্তরদাতা কর্মক্ষম এবং শিক্ষার কিছু স্তর পার করেছেন। ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন, ২৭ শতাংশ উচ্চবিদ্যালয় স্তর এবং ২৬ শতাংশ প্রাথমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩ শতাংশ শিক্ষার কোনো স্তরেই প্রবেশ করেননি। নিম্নমানের কর্মসংস্থান বাংলাদেশে এখনো একটি চ্যালেঞ্জ।

৪০ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কর্মহীন ছিলেন। ৯০ শতাংশ জানান, তাঁদের ব্যক্তিগত কোনো উপার্জন নেই বা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। আইওএম বলছে, নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীদের ধরন প্রায় একই রকম। অনিয়মিত অভিবাসীরা অল্পবয়সী, স্বল্প শিক্ষিত এবং মূলত বেকার হন বলেই ধারণা করা হয়। কিন্তু গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীদের বয়স ও শিক্ষার স্তর একই রকম।

আর বাংলাদেশে অভিবাসন মূলত দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে ঘটে। অধিকাংশ অভিবাসী মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার অন্যান্য দেশে অভিবাসন করে থাকেন। মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অধিকাংশ উত্তরদাতা জানান, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে গমনে ইচ্ছুক। গন্তব্য দেশ হিসেবে সৌদি আরব সবচেয়ে জনপ্রিয়।

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, অভিবাসনপ্রক্রিয়া শুরু করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছেন ৮৫ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী। নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছেন। নিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৫১ টাকা দিয়েছেন।

আর অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে দিয়েছেন ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৮ টাকা। অভিবাসনপ্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ টাকা দিয়েছেন একজন। আইওএম জানায়, আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস দেশ। ২০১৯ পর্যন্ত ৭৮ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে অবস্থান করেছেন।

প্রতিবছর এ দেশে ২২ লাখেরও বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তিতে যুক্ত হয়। কিন্তু স্থানীয় শ্রমবাজার এসব কর্মসংস্থানপ্রার্থীকে জায়গা দিতে সক্ষম নয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানসচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, শ্রম অভিবাসন খাতকে আরও ভালোমতো বুঝতে, কাজের সন্ধানে বিদেশ গমনকারীদের ডেটাবেইস তৈরি প্রয়োজন। আইওএমের প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের বিস্তারিত তুলে এনেছে।

উন্নত নীতিমালা ও অনুশীলন তৈরিতে প্রতিবেদনটি সহায়তা করবে। আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের আর্থসামাজিক চলনশক্তিগুলো নিয়ে কাজ করতে সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি শিক্ষা ও দক্ষতায় বিনিয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে উচ্চস্তরের আলোচনা ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে প্রতিবেদনটি।

Process