উপকূলজুড়ে ধ্বংসের চিহ্ন
পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা ও বরিশালের ওপর দিয়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মহাসেন উপকূলজুড়ে ধ্বংসের চিহ্ন রেখে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। হাজার হাজার পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।এখনো অনেকে কোনো ত্রাণসামগ্রী পায়নি। কয়েক হাজার হেক্টর জমির আউশের বীজতলা ও বোনা আউশ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে বহু চিংড়িঘের, ডুবে গেছে পানের বরজ। ভেঙে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। প্রথম আলোর অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিত:
পটুয়াখালী: জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে জানা যায়, মহাসেনের আঘাতে জেলার ২৫ হাজার ৭৭৮টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে সাত হাজার ৫৪০টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১৮ হাজার ২৩৮টি ঘরবাড়ি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়নের দুই হাজার ৩০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং চার হাজার ২০০ ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ জেড এম মমতাজুল করিম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ১০ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে আবাদ করা তিলের পুরোটা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া সাত হাজার ৪১০ হেক্টর জমির চিনাবাদাম, ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমির মরিচ, চার হাজার ২০০ হেক্টর আউশের বীজতলা, ৮৩৫ হেক্টর বোনা আউশ, দুই হাজার হেক্টর জমির শাকসবজি, পানের বরজ ৩৫০ হেক্টর, মুগডাল ২৪ হাজার হেক্টর এবং দুই হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা মিষ্টি আলু নষ্ট হয়ে গেছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী): পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের ৪৭/৫ নম্বর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় আড়াই শ ফুট বাঁধ ভেঙে গেছে।
পিরোজপুর: প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার কয়েক হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভান্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালী ও মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকা দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ ছাড়া অনেক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক অনল চন্দ্র দাস বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
বরগুনা: বরগুনায় কয়েক হাজার পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানো এসব পরিবারের সদস্যদের অনেকেরই তিন দিন ধরে খাবার জুটছে না। গতকাল বিষখালী নদীতীরের নলটোনা, বালিয়াতলী ও গৌরিচন্না ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগের দৃশ্য দেখা গেছে।
নলটোনা ইউনিয়ন, বালিয়াতলী ইউনিয়ন ও গৌরিচন্না ইউনিয়নের কয়েক হাজার বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বরগুনার ৭০ ভাগ এলাকা এখনো জলাবদ্ধ থাকায় প্রায় এক লাখ পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। এদের অনেকের ঘরে খাবার নেই। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় ১৬ হাজার ৯৯০টি বসতঘর সম্পূর্ণ ও ২৬ হাজার ৭০০ বসতঘর আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ১৯২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ক্ষতি হয়েছে ১৪৬ কিলোমিটার। এ ছাড়া জেলায় চার হাজারের বেশি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে।
আমতলী (বরগুনা): উপজেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, উপজেলায় ছয় হাজার ৫১০টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ২৩ হাজার ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
চরফ্যাশন (ভোলা): ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। তারা এখনো ত্রাণসামগ্রী পায়নি। এদিকে, প্রশাসন ও স্থানীয় সাংসদ বলছেন, ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে।
উপজেলার চর মানিকা ইউনিয়নের ক্লোজার বাঁধে একই লাইনে গোটা বিশেক ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, তাঁরা এখনো ত্রাণ পায়নি। চর মানিকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করীম বলেন, ‘আমি মাত্র দুই মেট্রিক টন চাল পেয়েছি। আজ শনিবার বিতরণ করা হবে। বৃহস্পতিবার লালমোহন ও চরফ্যাশনে নিখোঁজ হওয়া ৩০ জন জেলেকে পাওয়া গেছে।
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর-ই-আলম বলেন, ঢালচর, চর মানিকা, মুজিবনগর, কুকরি মুকরি গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে চার হাজার ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১০ হাজার আংশিকসহ কয়েক শ স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ বিধ্বস্ত হয়েছে।
গৌরনদী (বরিশাল): ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বোরোচাষিরা। কৃষি অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গৌরনদীর আট হাজার কৃষক চার হাজার ১৫০ হেক্টর জমির পাকা, আধাপাকা ও উঠতি বোরো ফসল এবং আগৈলঝাড়ার সাত হাজার কৃষক পাঁচ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমির পাকা, আধাপাকা ও উঠতি ফসল হারিয়েছেন।