উপজেলায় পরিকল্পিত নগরায়ণ কি অসম্ভব

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনাকালে তিন মাস ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। তাই অনেক দিন পর একটু সবুজের খোঁজে বের হয়েছিলাম। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে যদি একঘেয়ে জীবনযাত্রায় একটু ভিন্নতা আসে।

আসলে ছেলেবেলায় বাড়ির আশপাশে রাস্তার ধারে একটু পরপরই স্মৃতিবিজড়িত মাঠ ছিল কয়েকটা। অন্যান্য সময় তো বটেই, বর্ষার এই সময়টাতেও প্রায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত এই মাঠগুলোকে ঘিরে নানা রকম দস্যিপনায় মেতে থাকতাম। দেশি-বিদেশি কত রকমের খেলার যে আসর বসত। বর্ষাকালে কাদা পানিও আমাদের মাঠে খেলার মোহ থেকে দূরে রাখতে পারত না। আবার একটু বড় হয়ে খেলাধুলা-হইহুল্লোড় ওভাবে না করলেও বিকেলে হাঁটতে বের হতাম কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের ওপর নানা রঙের, নানা আকৃতির মেঘের আনাগোনা দেখে হরেক রকমের বস্তুর সঙ্গে মিলিয়ে গল্প ফেঁদে বসতাম। কোথাও থাকত পানি, কোথাও বা বিশাল ধানখেত। হাঁসেরা দলবেঁধে সাঁঝের বেলায় গৃহস্থবাড়ির দিকে যাত্রা করত। বকের সারি সারাটা দিন হন্যে হয়ে খাবার খুঁজে নীড়ে ফিরত সুদূর আকাশে ডানা মেলে। এসব দেখতাম আর অনাবিল এক প্রশান্তিতে মন ভরে উঠত।


কিন্তু আজ নিজ গৃহের আশপাশের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো বসতবাড়িতে পরিপূর্ণ। বাড়ির রাস্তা ধরে বাজারের উল্টো দিকে গ্রামের দিকে প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো হাঁটার পর এ রকম কিছু দৃশ্যের অবতারণা ঘটল। তা–ও অল্প কিছু জায়গায়। হবেই বা না কেন? আবাদি বা কৃষিজমির জায়গা যে দিন দিন বসতবাড়ি দখল করে নিচ্ছে। আর উপজেলা সদরের বাড়িগুলো যেন গ্রামের বাড়ির সব নান্দনিকতা হারাচ্ছে। উঠান বা পুকুর নেই। শুধু ঘরের পর ঘর। যত ঘর, ভাড়া দিয়ে তত অর্থ উপার্জন। বাড়ির চারধারে শোভাবর্ধক ফুল-ফলের গাছপালা রাখাও গুরুত্বহীন বাড়ির মালিকের কাছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বা গরমের দিনে জ্যোৎস্না রাতে উঠানে শীতল পাটি বা কাঠের পিঁড়ি বিছিয়ে সবাই মিলে বসে গল্প করা বা গানের কলি খেলতেও আজকাল দেখা যায় না৷ উপজেলাতে দেখা যায় অনেক ভবনের ছাদগুলোও ওভাবে সবাইকে নিয়ে বসার জন্য উপযোগী করে রাখা হয় না। একটা ছাদেরও যে আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকতে পারে, পুঁজিবাদী মনমানসিকতার কারও কারও মাথায় সে চিন্তা হয়তো কখনো উঁকিও দেয় না। ছাদটাকেও গোডাউন বানিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করার পরিকল্পনায় তাঁরা মত্ত।

বর্তমান প্রজন্মের ঠিক আগের প্রজন্মের অনেককেই উদাস মনে ঘরের দুয়ারে বা জানালার ধারে বসে থাকতে দেখা যায়। তার অবচেতন মনও হয়তো পুরোনো দিনের সুখস্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়, সোঁদা মাটির গন্ধ খুঁজে খুঁজে দিশেহারা হয়।
বর্তমান প্রজন্মের স্কুলগামী অধিকাংশ ছেলেমেয়ের কাছে প্রকৃতি অপার মহিমা হয়ে এ রকম আর ধরা দেয় না শারীরিক কসরতের খেলাধুলা ভুলে গিয়ে ভার্চ্যুয়াল জগতে ডুবে থাকতেই ব্যতিব্যস্ত তারা। ঘরে ঘরে শিশু-কিশোর বা তাদের মা–বাবার স্মার্টফোনে পাবজিসহ নানা রকম গেমস ইনস্টল করা। প্রথম প্রথম একটু–আধটু করে শুরু করতে গিয়ে একসময় আসক্ত হয়ে পড়ে তারা। বিপত্তিটা ঘটে তখনই।

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশেষজ্ঞদের মতে, তা তাদের আচরণগত দিক ছাড়াও নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আগের মতো মাঠঘাট থাকলে বিকেলবেলায় খেলাধুলা করে এ আসক্তি থেকে অনেকটাই মুক্তি লাভ করতে পারত তারা। বর্ষাকালে কিছু কিছু মাঠ তলিয়ে গেলেও কোনো কোনো খোলা জায়গায় অন্তত ছোট পরিসরেও খেলার আয়োজন করা যেত। এ ছাড়া অনেকক্ষণ বই পড়লে কিংবা মুঠোফোনে তাকিয়ে থাকলে চোখে যে শ্রান্তি আসে, তা দূর করার জন্য বাড়ির সবুজ গাছপালা বা বাসার পাশের সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে থেকে তা নিবারণ করার সুযোগটা থেকেও তারা বঞ্চিত।
সত্যি কথা বলতে গ্রামগুলো দিন দিন নগরে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু সে নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে নয়, অপরিকল্পিতভাবে। ব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো, সমষ্টিগত স্বার্থ সেখানে তুচ্ছ।

জনসংখ্যা যে অনুপাতে বাড়ছে, সে অনুপাতে জমি তো আর বাড়ছে না। সময় যত গড়াবে, নতুন নতুন বাড়িঘর, কলকারখানা তত বাড়বেই। তবে তা পরিকল্পনামাফিক হওয়া চাই। এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সজাগ দৃষ্টি দেওয়া আশু প্রয়োজন। অন্ততপক্ষে তারা উপজেলা পর্যায়ে একটি আদর্শ বাড়ি কেমন হওয়া উচিত, খেলার মাঠ রাখার প্রয়োজনীয়তা, কৃষিজমি সংরক্ষণের গুরুত্ব এ রকম কিছু বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এ বিষয়ে নানা রকম বিজ্ঞাপন দেওয়া যেতে পারে। জনসাধারণকে এখনই সচেতন না করলে ভবিষ্যতে কোনো এক সময় বড় ধরনের কোনো মাশুল দিতে হবে কি না, তারই নিশ্চয়তা বা কে দিতে পারে?
তাই তো পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের কথায় সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’

*সহকারী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।