উপহারের মোড়ক খুলেও দেখেনি মারিয়াম
‘রাজকন্যা’র মতোই মারিয়াম রুহীকে বড় করছিলেন রাফিকা পাঠান। মো. আবু সুফিয়ানও মেয়ের জন্য দুহাত খোলা। প্রতি উৎসবে কেনা হয় হালফ্যাশনের জামা, বদলে যায় মারিয়ামের চুলের ছাঁট থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত। এবারও জন্মদিনের মাসখানেক আগে থেকে নেওয়া হয় উদ্যাপনের প্রস্তুতি। কেনা হয় নতুন জামা। তবে এমন ব্যথাতুর জন্মদিন আর কখনো কাটেনি মারিয়ামের। স্বজনদেরও এভাবে কখনো বুকে শোক চেপে মুখে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হয়নি!
স্বজনেরা জানান, রাফিকার মৃত্যুর পরদিন গত বৃহস্পতিবার তাঁরা মারিয়াম রুহীর (৮) জন্মদিন পালন করেন। উপহারে উপহারে ভরিয়ে দেন তাকে। মায়ের মৃত্যুশোকে কাতর মেয়েটি একটা উপহারের মোড়কও খুলে দেখেনি। মারিয়ামের বাবা আবু সুফিয়ান গতকাল শনিবার ঘুরেফিরে একটা কথা বলছিলেন, ‘আমার ব্রেইনে আর কুলায় না! আমি কী করব, কেউ বলে দিক।’
ওয়ারীর ভজহরি সাহা স্ট্রিটের একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে মারিয়ামরা। গত বুধবার সুখের এই সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
মারিয়াম কেমন আছে? আবু সুফিয়ান বলেন, গতকাল মায়ের ঘরে শুয়ে জোরে জোরে পা ঠুকতে দেখেন মারিয়ামকে। সে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। এক মুহূর্তও যেন ওকে একা থাকতে না হয়, সবাই মিলে সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমরা রিকশায় গল্প করতে করতে আসছিলাম। খারাপ দেখতে একটা বাস ব্রেক ফেল করে আমাদের ধাক্কা দিল। শুধু আমাদের না, একসঙ্গে অনেক মানুষকে। দেখি আম্মু গাড়ির চাকার নিচে। আমিও পড়ে গেলাম, আমার বই–খাতা–ব্যাগ সবই রাস্তায়। আম্মুর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে হাসপাতালে নিলমারিয়াম
তিনি জানান, রোজা উপলক্ষে মানিকগঞ্জ থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন বাসায়। রাফিকার ছোট ভাই আছেন। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন আসছেন। মারিয়ামকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা চলছে সব সময়।
ভোরবেলা মারিয়ামকে একা হাতেই স্কুলের জন্য তৈরি করতেন রাফিকা। টিফিনে কী নেবে, ফিরে এসে কী খাবে, কটায় গোসল করবে কিংবা কী রঙের জামা পরবে, তা নিয়েই ছিল তাঁর মূল ব্যস্ততা। রাফিকা ছাড়া এই কটা দিন পরিবারের কেমন গেছে, তা শুধু তাঁরাই জানেন।
গতকাল বাসায় ঢুকে দেখা গেল, একটা হলদে রঙের মুরগির বাচ্চা হাতে করে ঘুরছে মারিয়াম। তাকে খাওয়াচ্ছে, গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ঘুম পাড়ানোর চেষ্টাও করছে। নাম রেখেছে ‘কমলা’। মারিয়ামের পরনে কালো ও ছাইরঙা গাউন। বাবা–মায়ের কোলে চড়ে এই জামাটাই সে কদিন আগে কিনে এনেছিল।
মারিয়াম জানায়, মুরগির বাচ্চাটার মা নেই। তাই সে–ই এখন ওর মা। ‘কমলা’র আচার–ব্যবহার তার মতোই, মায়ের কথা শোনে! মারিয়াম যখন এসব কথা বলছিল, পরিবারের কেউ চোখের পানি মোছেন, কেউ মুখ চাপা দিয়ে কান্নার শব্দ আটকান!
আবু সুফিয়ান বলেন, গত বুধবার মারিয়াম তার ছোট মামার সঙ্গে মোটরসাইকেলে স্কুলে গিয়েছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাফিকা মেয়েকে আনতে কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যান। আবু সুফিয়ান ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলেন মিরপুরে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের ফোন পান তিনি। জানতে পারেন, সড়ক দুর্ঘটনায় রাফিকা গুরুতর আহত। জ্যাম ঠেলে ঘণ্টা দুয়েক বাদে তিনি যখন হাসপাতালে পৌঁছান, তখন স্ত্রী মারা গেছেন।
আবু সুফিয়ানের পাশে কমলাকে কোলে রেখে পাশ থেকে মারিয়াম বলে, ‘আমরা রিকশায় গল্প করতে করতে আসছিলাম। খারাপ দেখতে একটা বাস ব্রেক ফেল করে আমাদের ধাক্কা দিল। শুধু আমাদের না, একসঙ্গে অনেক মানুষকে। দেখি আম্মু গাড়ির চাকার নিচে। আমিও পড়ে গেলাম, আমার বই–খাতা–ব্যাগ সবই রাস্তায়। আম্মুর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে হাসপাতালে নিল।’
স্বজনেরা জানান, মারিয়ামের আঘাত ছিল সামান্যই। তবে দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলার কাগজপত্র বলছে, রাফিকার আঘাত ছিল গুরুতর। তাঁর কপাল, বাম কান, নাক ও মাথা চেপ্টে যায়। মগজ বেরিয়ে এসেছিল।
ওরা স্থায়ীভাবে বগুড়ার ধুনটে নানা–নানির কাছে চলে গেছে। পড়ালেখার জন্যই মায়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকত ওরা। মা নেই, ঢাকায় ওদের দেখাশোনা করারও কেউ নেই। তাই পারিবারিক সিদ্ধান্তে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওদের।হুমায়রা ও রাফিয়ার চাচা জামিল হোসেন
আনন্দ পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় রাফিকা মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়। বাসচালককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আবু সুফিয়ান বলেন, এত পুরোনো মডেলের লক্কড়ঝক্কড় বাস কী করে রাস্তায় নামে, কারা অনুমতি দেয়? এসব খতিয়ে দেখা হোক। আর কারও সন্তান যেন মা–হারা না হয়।
ঢাকার পাট চুকিয়ে বগুড়ায় গেল মা–হারা দুই বোন
মিরপুর ১৪ নম্বরে নেভি মার্কেটের সামনে গত মঙ্গলবার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সাবিনা ইয়াসমিন। অটোরিকশায় দুই মেয়েকে নিয়ে নেভি স্কুলে যাওয়ার পথে বাসের ধাক্কায় নিহত হন তিনি। বগুড়ার ধুনটে মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে গিয়েছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী হুমায়রা ইয়াসমিন (৯) ও রাফিয়া ইয়াসমিন (৪)।
গতকাল রাতে হুমায়রা ও রাফিয়ার চাচা জামিল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওরা স্থায়ীভাবে বগুড়ার ধুনটে নানা–নানির কাছে চলে গেছে। পড়ালেখার জন্যই মায়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকত ওরা। মা নেই, ঢাকায় ওদের দেখাশোনা করারও কেউ নেই। তাই পারিবারিক সিদ্ধান্তে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওদের।
এত পুরোনো মডেলের লক্কড়ঝক্কড় বাস কী করে রাস্তায় নামে, কারা অনুমতি দেয়? এসব খতিয়ে দেখা হোক। আর কারও সন্তান যেন মা–হারা না হয়।আবু সুফিয়ান
ওরা কেমন আছে, জানতে চাইলে জামিল হোসেন বলেন, মা ছাড়া যেমন থাকা যায়, ওরা তেমনই আছে। হুমায়রা এখনো চুপ করে আছে, নিজের মতো। রাফিয়া ঘুরেফিরে আত্মীয়স্বজনের কাছে মায়ের খোঁজ নেয়। কখনো অনুনয়–বিনয় করে, কখনো মাকে দেখার জন্য জেদ ধরে। মায়ের সঙ্গেই ঘুমাত সে। এখন সে ঠিকমতো খায়ও না, ঘুমায়ও না।