উপাচার্যদের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ

>
  • আট উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে ইউজিসি। আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে।
  • রাজনৈতিক পরিচয়ে উপাচার্য হওয়া শিক্ষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে গুরুত্ব দেন না।

স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনেকের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এই মুহূর্তে বর্তমান ও সাবেক আটজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আরও অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হচ্ছে অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সাধারণত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠলেও ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বড় হলে বড়জোর কোনো কোনো উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া বা পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিচয়ে উপাচার্য হওয়া শিক্ষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বও দেন না। এমন অবস্থায় ‘ক্ষমতাবান’ এসব উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন ইউজিসিও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। সরকার বললে কেবল তদন্ত করে সুপারিশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেই তদন্তও আলোর মুখ দেখে না। এমনকি তদন্ত করতে গিয়ে উপাচার্যের চাপে ইউজিসির তদন্ত দলকে ফিরে আসারও উদাহরণ রয়েছে।

উপাচার্যের নিয়োগ দেওয়া ও তাঁদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আচার্যের। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পরামর্শও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) সাচিবিক কাজটি করে থাকে। ফলে রাষ্ট্রপতি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে এসব বিষয় অবহিত করার মূল দায়িত্বও তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত শনিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপাচার্যদের দুর্নীতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আচার্য প্রশ্ন রাখেন, ‘উপাচার্যরা যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে?’ তাঁর এ বক্তব্যের পর উপাচার্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা চলছে।

বর্তমানে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ৪৬টি। মন্ত্রিসভায় আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

গত ১১ ডিসেম্বর ইউজিসির এক চিঠিতে উপাচার্যদের নিয়ম ভঙ্গের প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই নতুন বিভাগ, প্রোগ্রাম ও ইনস্টিটিউট খুলে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হচ্ছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে। সরকারের আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করে দেওয়া হচ্ছে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা। এসব কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিয়ম মানার পরামর্শ দেওয়া হয়।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যদের অনেকে পদে বসেই নিজেদের গদিনশিন মনে করতে থাকেন। গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। এই প্রক্রিয়ায় আর্থিক অনিয়ম থেকে শুরু করে ক্ষমতার অব্যবহার ও অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ থেকে বেরোতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের নিজেদের শিক্ষক ভাবতে হবে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর কথার খুবই গুরুত্ব আছে। আশা থাকবে, উপাচার্যদের নিয়োগকর্তা হিসেবে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

তদন্তের মুখে আটজন
আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি। এর মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে এক কাজের জন্য একাধিকবার সম্মানী নেওয়া, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসি তদন্তের কথা বললেও প্রতিবেদন আলোর মুখে দেখছে না।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ স্থগিত রাখতে বললেও তা অমান্য করেই তাঁর সময়ে বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ইউজিসির একটি তদন্ত দল তদন্তে গেলে উপাচার্যপন্থী বলে পরিচিত কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকদের মহড়ায় ভীত হয়ে তদন্ত দল ঢাকায় ফিরে আসতে হয়। যদিও এম. অহিদুজ্জামান আগে থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমানের বিষয়েও তদন্ত চলছে। গত ডিসেম্বরে এই প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গিয়ে সেশনজটের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ জানতে পারেন। যদিও উপাচার্য অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম.আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ কয়েকটি দপ্তরে জমা দিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ। তাঁর বিরুদ্ধেও তদন্ত হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার সঙ্গে একজন চাকরিপ্রার্থীর স্ত্রীর মুঠোফোনে টাকা লেনদেনের আলোচনার অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার বিষয়টি খুবই আলোচিত। সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইউজিসির একজন কর্মকর্তা।

তদন্ত হচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আবদুস সাত্তারের বিষয়েও। এ ছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যও আছেন তদন্তের মুখে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে তদন্ত করছেন। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা ও নাম বলতে চাননি।

আরও যত অভিযোগ
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মধ্যস্থতায় উন্নয়নকাজের টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত আগস্ট থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। ওই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার অভিযোগকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে ইউজিসি দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো লিখিত নির্দেশ পাননি।

এক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগে গত অক্টোবরে বেশ কিছুদিন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম রুস্তম আলীর পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। এখনো এ অভিযোগের সুরাহা হয়নি।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্যাগে বাধ্য হওয়া উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ছিল বহু পুরোনো। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন শিক্ষার্থীরা তাঁর পদত্যাগের এক দফা দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু করেন, তখন তদন্তে নামে ইউজিসি। প্রত্যাহার করার জন্য সুপারিশ জমা দেওয়ার দিন গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন এবং রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছাড়েন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক এই উপাচার্যের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।

গত বছর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম ইমামুল হকের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললে তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটির নামে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তাঁকে মেয়াদ শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয়।

রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করে ক্যাম্পাসে নিয়মিত থাকেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় এক নারী প্রার্থীকে বিব্রতকর প্রশ্ন করে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেছেন। অবশ্য ফায়েক উজ্জামান বলে আসছেন, এটা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।

ইউজিসি সূত্র জানায়, দুদকের মামলায় জেল খাটা একমাত্র উপাচার্য হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-অনিয়মে রেকর্ড গড়া সাবেক উপাচার্য মু. আবদুল জলিল মিয়া। ২০১৩ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে তাঁকে সরিয়েও দেওয়া হয়েছিল।

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যদের সততা কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, যা অনভিপ্রেত। এ বিষয়ে ইউজিসির নজরদারি বাড়াতে হবে। শুধু ক্ষমতা নেই বললে চলবে না। আর উপাচার্যদের যেহেতু সরকার নিয়োগ দেয়, সেহেতু সরকারের উচিত শুধু রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় না নিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও সততার দিকটি দেখা। এ ছাড়া কোনো উপাচার্য যদি দুর্নীতি করেন, তাহলে দুদকের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।