৯২টি বছর সক্রিয় সৃষ্টিশীলতার মধ্যে অতিক্রম করেছেন যিনি, তিনি তো সুস্থই ছিলেন। গত এক বছরে বয়সজনিত সমস্যার পাশাপাশি করোনা মহামারি থেকে নিজেকে দূরে রাখলেও নিবু নিবু করছে তাঁর দৃষ্টিশক্তি। লিখতে-পড়তে পারেন না কিছুই। চিকিৎসকের ভাষায়, দৃষ্টিশক্তির ডিজেনারেশন বা অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে, যা কোনো চিকিৎসাতেই পূর্বাবস্থায় ফেরানো সম্ভব নয়। তাই স্বজনহীন এক সন্তের মতো লেখক-জীবন কাটাচ্ছেন আহমদ রফিক। লেখাই জীবন, লেখাই উপার্জন—এই দুই প্রত্যয়ই আজ অচল হয়ে পড়েছে তাঁর ক্ষেত্রে। ফলে রুদ্ধ হয়ে গেছে উপার্জনের পথ। বয়স এত দিন একটি সংখ্যাই ছিল তাঁর কাছে। অত্যন্ত প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই ভাষাসংগ্রামীর মস্তিষ্ক এখনো সচল। তাঁর ভাষায়, বয়স ৯০ অতিক্রম করলেও স্মৃতিশক্তির প্রাখর্য এখনো যেকোনো বয়সী তরুণের মতো।
বিষয়-সম্পদের প্রতি অনীহ আহমদ রফিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সংগঠন ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশে তৎপর ছিলেন বহুদিন। মানুষের বিপদে হাত বাড়িয়েছেন সাধ্যমতো। তরুণদের দিয়েছেন পৃষ্ঠপোষকতা। সুযোগ থাকলেও নিজ জীবনের প্রতিকূলতা কিংবা বয়সজনিত স্থবিরতার কথা ভাবেননি। রবীন্দ্র-গবেষণা বৃত্তির জন্য টাকা দান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবৈষয়িক মানুষটি আজ হয়ে পড়েছেন সহায়-সম্বলহীন। কারণ, বেঁচে থাকলে অবশিষ্ট সঞ্চয় দিয়ে হয়তো চলতে পারবেন মাত্র বছরখানেক। এরপর? এরপরের ভাবনা তিনি ভাবেন না, ভাবতেও চান না। যেন গুনছেন স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রহর!
৯৩তম জন্মদিনের প্রাক্কালে কথা বললেন জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-খ্যাতি নিয়ে। যেন মেলে ধরলেন তাঁর উপলব্ধি ও স্মৃতির খেরোখাতা। অজাতশত্রু আহমদ রফিকের জীবনও আর দশটা মানুষের মতোই মিশ্র অনুভূতিতে ভরপুর। তাঁর উপলব্ধি, ঘটনা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ প্রতিনিয়ত ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়—সেটা হতে পারে অনুকূল, প্রতিকূলও। তবে তাঁর ক্ষেত্রে প্রতিকূল ঘটনাই বেশি, যা তাঁর জীবনকে নতুন পথে যেতে বাধ্য করেছে বারবার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। সভায়-মিছিলে অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই হত্যাকাণ্ডের পর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার পরিকল্পনা করেন যে তিন-চারজন, তাঁদের একজন তিনি। ঢাকার পঞ্চায়েতপ্রধান পিয়ারু সরদারের সহযোগিতায় রাতভর নির্মিত তাঁদের সেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান সরকারের প্রধান শত্রু। একুশে ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী সময়পর্বে সেই শহীদ মিনারই যে প্রায় সব বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিল। জনতার ঢল নেমেছিল রাজপথে। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে আর কারও শিক্ষা ও পেশাজীবন ব্যাহত হয়েছে বলে শোনা যায় না। কিন্তু তাঁর হয়েছিল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল আত্মগোপনে। ফলে চিকিৎসক হিসেবে পেশাজীবন শুরু না করতে পারলেও তিনি যে মননশীল সাহিত্যকে নিজের চিন্তাপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তা দিয়েই জীবনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করে গেছেন। লেখালেখির বিষয় ও ধরনে তিনি যেন প্রতিনিয়ত সমাজেরই চিকিৎসা করে গেছেন। পঞ্চাশের দশকে আহমদ রফিকের মতো খুব কম লেখকই বাংলা প্রবন্ধ–সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে। রবীন্দ্রভুবনে পতিসর, রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম: কৃষি ও কৃষক, ছোটগল্পের শিল্পরূপ: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প, রবীন্দ্রজীবন, দেশবিভাগ ফিরে দেখা, মৃত্যুহীন বিপ্লবী চে গুয়েভারা, ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বাংলাদেশের কবিতা: দশকভাঙা বিচার প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
গত মার্চ মাসের এক মধ্যরাতে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যান আহমদ রফিক। কোমরের জয়েন্টের হাড় ভেঙে যায়। চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সফল অস্ত্রোপচারও সম্পন্ন হয়। কিন্তু জটিলতা পিছু ছাড়েনি। গত বছর তাঁর জন্মদিনের প্রাক্কালে লিখেছিলাম—একেবারে শেষ বাক্যে, ‘আহমদ রফিক সুস্থ ও সক্রিয় থেকে শতায়ু লাভ করুন।’ কিন্তু আজকে তাঁর জন্মদিনে এসে সংশয় ভর করছে। তিনি শতবর্ষ ছুঁতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কিন্তু তিনি যে সুস্থ নেই, তা বলতে কোনো সংশয় নেই।
আহমদ রফিকের বর্তমান অবস্থায় চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহে রাষ্ট্র যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে না আসে, তাঁর উপার্জনহীন ভবিষ্যৎ জীবন অত্যন্ত শঙ্কায় পড়ে যাবে। শতাধিক মননশীল গ্রন্থের লেখক, একজন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীর লড়াই এভাবে থেমে যাক, আমরা চাই না। তাঁর জন্য রাষ্ট্র উদারতার পরিচয় দেবে, আমরা সেই প্রত্যাশা করি। শুভ জন্মদিন, আহমদ রফিক।