ঋজু এক দীপশিখা

কেউ কি এখন মনে করতে পারবে, ২২ মে গরমটা কেমন পড়েছিল? নড়াইল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে সেদিন ভাষা প্রতিযোগ। অঞ্চলের কিছু এলাকায় চলছে বাস ধর্মঘট। কোনো কোনো এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা বাস ভাড়া করে এসেছে। আর এসেই দেখে, মরুভূমির উষ্ণতা! বেশ কিছু ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু গরম বাতাস সরিয়ে কজন মানুষের শরীরে তা বুলিয়ে দিতে পারে শান্তির পরশ? আমরা ভয়ে থাকি, এই বুঝি কোনো শিশু গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে!

অবাক হই দেখে, এই প্রচণ্ড তাপকে গ্রাহ্যই করল না শিশুরা। ৪০ মিনিটের পরীক্ষা দিয়ে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াতে লাগল ভেন্যুজুড়ে। খাতা দেখা চলছে। আর সেই ফাঁকে শিক্ষকেরা উঠে এসেছেন মঞ্চে, ওদেরই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। আমরা লক্ষ করছি, অভিভাবকেরা কিংবা ভেন্যুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা গরমে হাঁসফাঁস করছেন। কেউ কেউ বলছেন, দ্রুত শেষ করে দিন অনুষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা? তারা কিন্তু নিজেদের প্রশ্ন নিয়েই ব্যস্ত। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে ছিল একটি করে মনকাড়া বই। আমাদের প্রিয় শিক্ষক মাহবুবুল হক, সৈয়দ আজিজুল হক, কুদরত-ই-হুদা, সাইফিন রুবাইয়াত আর প্রতিযোগের সমন্বয়কারী তারিক মনজুর খুব আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলেন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের।

আর পুলক নামের ওই তারকা ছেলেটি, গানের জলে ভাসিয়ে গরম আবহাওয়াকে এক্কেবারে শীতল করে তুলল, শিশুদের কোমল মনকে করে তুলল উষ্ণ। শিশুরা যে এ রকম গানের ভক্ত, তা বোঝা যেত না ভেন্যুজুড়ে ওদের করতালির শব্দ না শুনলে। প্রতিযোগ শেষ হলে আমাদের আকর্ষণ ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি আর শিল্পী সুলতানের শিশুস্বর্গের স্পর্শ পাওয়া। তাতে মন ভরতে কতক্ষণ?

এরপর দুটি মাইক্রোবাসে করে বরিশালের পথে। শিক্ষকে-পূর্ণ মাইক্রোবাসে ঠাঁই হয়েছিল আমার। তাই ভাষা ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে তাঁদের কথা শুনতে শুনতে নদীর কাছাকাছি হই আমরা। ঢাকা থেকে নড়াইল যাওয়ার পথে মধুমতীর তীরে চা খেয়েছিলাম, গরুর দুধের চা। দারুণ ছিল সেটা। সেই চা আবার আমরা খাই ফেরার পথে। তারপর মাইক্রোবাসকে ফেরির হাতে তুলে দিয়ে আমরা নৌকায় করে মধুমতী পার হই। সে এক অসাধারণ ঘটনা। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে যেন ফিরে আসে শৈশব। চিৎকার করে লোকগান করার সময় আমাদের সঙ্গে সুর মেলান জুন-জুলাইয়ে পেনশনে যাবেন, এমন এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকও।

বরিশালে দেখি, তাপদাহ কম। নড়াইলে মাথার ওপর তেরপল ছিল না, বরিশালের জগদীশ সারস্বত বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে সেটা আছে। খুব হিসাব করে বরিশালের অনুষ্ঠানও শুরু হলো। পরীক্ষা হলো, প্রশ্ন হলো, উত্তর হলো, গান হলো। যে মেয়েটি এখানে সেরাদের সেরা হলো, তার বাক্য চয়ন আর ভাবনার গভীরতায় মুগ্ধ হই আমরা। বাংলা ভাষা আর সাহিত্যকে ভুলে যাচ্ছে মানুষ, এ রকম একটি কথা বলার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে; কিন্তু এই মেয়েটির মতো শিশুরাও যে পাশাপাশি বেড়ে উঠছে, তা জানতে পেরে মন ভালো হয়ে যায় আমাদের।

সেই কত বছর ধরে ভাষা প্রতিযোগে যাচ্ছি। কিন্তু তা যেন আর পুরোনো হয় না। ভাষা প্রতিযোগের অনুষ্ঠানে গেলে প্রতিবারই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হয়। নতুন শিশুদের সংস্পর্শে এসে বাঁচার প্রেরণা পাই। চারদিকের সংশয়-ভরা বাস্তবতার মধ্যে ভাষা প্রতিযোগ হয়ে ওঠে ঋজু এক দীপশিখা, যা পরিণত হয় শিখা অনির্বাণে।