এ কে শামসুদ্দিন

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

স্কেচ: মোজাম্মেল হক
স্কেচ: মোজাম্মেল হক

একাত্তরে সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন এ কে শামসুদ্দিন। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের (পরে মুক্তিবাহিনী) সহায়তা করেন।
৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের আরিচা ঘাটে পৌঁছানোর খবর শুনে তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে ট্রেজারিতে থাকা রাইফেল তুলে দেন। পরে তাঁরই নেতৃত্বে বাঘাবাড়ী ঘাট ও নগরবাড়ী ঘাটে প্রতিরোধযোদ্ধারা সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যোদ্ধাদের সঙ্গে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বাহিনীর একদল বাঙালি সেনাও ছিল। প্রতিরোধযোদ্ধারা তখন তাঁকে কর্নেল উপাধি দেন। কাশীনাথপুরের ডাব বাগান, বাঘাবাড়ী ঘাট, উল্লাপাড়ার ঘাটিনা সেতুর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাবনা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
পরে সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। এ কে শামসুদ্দিন তাঁর অধীনস্থ প্রতিরোধযোদ্ধাদের ভারতের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়ে প্রথমে আত্মগোপন করেন। তাঁরও ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ সময় তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ঢাকার ১০৮ ফকিরাপুলে তাঁদের নিজস্ব বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। স্ত্রীকে দেখার জন্য তিনি গোপনে ঢাকায় আসেন। ওই বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৭ মে তাঁকে আটক করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখানে সেনাবাহিনীর মেজর সরফরাজের নেতৃত্বে তাঁর ওপর অকথ্য ও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তাঁর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্তও বের করে নেওয়া হয়। ১৯ মে সেনারা তাঁকে হত্যা করে।
টাঙ্গাইল শহরের মাতুলালয়ে ১৯৪৩ সালের ২ আগস্ট এ কে শামসুদ্দিনের জন্ম। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা গ্রামে। তাঁর ডাকনাম খোকা। শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তাঁর মাতামহ। বাবা আফাজউদ্দিন আহমদ, মা রাবেয়া খাতুন। আফাজউদ্দিন আহমদ ডাক ও তার বিভাগে চাকরি করতেন।
এ কে শামসুদ্দিন গয়হাটা মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকার নবাবপুর গভ. হাইস্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে ১৭তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর পাকিস্তান সরকারের ইন্টার উইং স্কলারশিপ নিয়ে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে কেমিস্ট্রিতে অনার্স পড়তে যান। কৃতিত্বের জন্য বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ‘সায়গল স্কলারশিপ’ পান। এ স্কলারশিপ তখন শুধু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। এ কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএসসি অনার্স পাস করেন। পরবর্তীকালে এমএসসি পরীক্ষায়ও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। পড়াশোনা শেষে তিনি প্রথমে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। এ পরীক্ষায় তিনি সমগ্র পাকিস্তানে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ কে শামসুদ্দিনকে হত্যার পাঁচ মাস পর তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ছেলের নাম এ কে এম সালাহউদ্দীন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং নাসায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
এ কে সামসুদ্দিন বনানী সামরিক কবরস্থানে সমাহিত। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত এবং সেখানে নামফলক রয়েছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর গয়হাটা গ্রামে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ শামসুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
সূত্র: ১. আবদুল মান্নান (শহীদ এ কে শামসুদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র) ২. ওরা ক’জনা মুক্তিসেনা, হাসানুর রহমান, প্রথম প্রকাশ ১৯৯১ স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
<[email protected]>