এই মোমবাতির নাম 'নয়ন ভাই'

‘প্রবাসীরা হলেন মোমবাতির মতো। মোমবাতি যতক্ষণ আলো দেয়, ততক্ষণ সবাই কদর করে। কিন্তু নিভে গেলেই শেষ। প্রবাসীরাও নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরলে আপনজনও আর তাঁদের চিনতে চান না।’—কথাগুলো বলছিলেন আল-আমিন। বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারী-পুরুষের কাছে তিনি ‘নয়ন ভাই’ নামেই পরিচিত।
সম্প্রতি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে আলাপচারিতায় আল-আমিন (৩৬) জানালেন, তিনি নিজেও মালয়েশিয়ায় গিয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর জীবন পুরোটাই অনিশ্চয়তায় ঢেকে যায় ২৫ বছর বয়সে।
আল-আমিনের বাড়ি রাজশাহী। তাঁর এক বোন আছে। বাবা কৃষক। মা গৃহিণী। ২০০৭ সালে আল-আমিনের চারপাশের লোকের মধ্যে মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়ে। মালয়েশিয়া যাওয়ার হাতছানি তাঁকেও ডাকে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। জমি বিক্রি করে তাঁর বাবা তাঁকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিলেন।
আল-আমিনকে দালাল জানিয়েছিলেন, সনি ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে চাকরি হবে। বেতন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। পাসপোর্ট ও সরকারি ছাড়পত্র নিয়েই তিনি মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু যাওয়ার পরেই বুঝতে পারেন, তিনিসহ অন্যদের আসলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
তামিল এক মালিকের অধীনে আল-আমিনদের পাহাড়ের জঙ্গল কাটতে হতো। সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো—উপদ্রব সবই সহ্য করতে হতো। কাজ করতে না চাইলে তাঁর ওপর নেমে আসত চরম নির্যাতন। লাঠি দিয়ে পিটুনি ছাড়াও নানা কায়দায় নির্যাতন করা হতো।
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা থেকে খাওয়ার পানি আনতে হতো। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে ছয়জন আত্মহত্যা করার হুমকি দেন। তখন তাঁদের ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে এক ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। জানালা ভেঙে আল-আমিনসহ ১১০ জন পালান। দূতাবাসের কাছে সহায়তা পাওয়ার জন্য গিয়েও তাঁদের লাভ হয়নি। প্রায় সাত মাস বেতন ছাড়া, আশ্রয় ছাড়া মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিকেরা দূতাবাসের সামনে অনশনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নামেন। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই আন্দোলনের খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। অবশেষে তানাগানিতা নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় ৮০ জন খালি হাতে শুধু প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসতে সক্ষম হন।
আল-আমিন জানালেন, তিনি যখন খালি হাতে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরত আসেন, তখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে লোকে টিটকারি মারত। উপহাস করত। সবাই বলত, এখন আর কী করবে? ঢাকায় গিয়ে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসো।
দেশে আসার পর একপর্যায়ে মালয়েশিয়া যাওয়া বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত পান আল-আমিন। আল-আমিনসহ দেশে ফেরত আসা শ্রমিকেরা ইমা রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন চালু করেন। কিন্তু একপর্যায়ে সে সংগঠনে নানা কারণে ভাঙন লাগে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আল-আমিন অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়েই তখন থেকে কাজ করছেন।
আল-আমিন বলেন, ‘বিদেশে কাজে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসার যে কষ্ট, তা আমার চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে! নিজে ভিকটিম তো, তাই অন্যদের কষ্টটা বুঝতে পারি। বিমানবন্দরে ফেরত আসা শ্রমিকেরা যখন নির্যাতনের কাহিনি বলতে থাকেন, আমি তখন আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া দিনগুলো চোখের সামনে দেখতে পাই। বুঝতে পারি, কোন ধরনের পরিস্থিতি হলে বিদেশে কেউ আত্মহত্যা করতে চান বা দেশে ফেরত চলে আসতে চান। আমি নিজেও দেশে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে অনশন করা, আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলাম। খাওয়ার টাকা না থাকায় অন্যের কাছে হাত পাততেও হয়েছিল। আমি পুরুষ বলে হয়তো শুধু যৌন নির্যাতনের শিকার হইনি।’
সম্প্রতি সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসা নারী গৃহকর্মীর সংখ্যাটা বেড়েছে। আল-আমিন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচিতে গত বছরের অক্টোবর থেকে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে এই নারীদের জরুরি সহায়তা দেওয়ার কাজ করছেন।
দিন আর রাত নেই, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীরা পাশে পান তাঁদের নয়ন ভাইকে। দেশে ফেরা বেশির ভাগ নারীর সঙ্গে আল-আমিনের মুঠোফোনে আগেই কথা হয়। তাই এই নারীদের কাছে আল-আমিনকে খুব একটা অপরিচিত লাগে না। আর আল-আমিনও আপা, বুবু, খালা—যাঁকে যা ডাকলে মানানসই হয়, সেভাবে ফেরত আসা নারীদের সঙ্গে কথা বলেন।
নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগই তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া অমানুষিক ঘটনার কথা বিমানবন্দরে নেমে আল-আমিনের কাছে বলেন। নির্যাতনের ধরন অনুযায়ী কার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা অফিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন আল-আমিন। অনেক সময় তিনি নিজেই ব্যবস্থা নেন। পরে কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করেন।
আল-আমিন জানালেন, দেশে ফেরত আসা নারীদের বাড়ি পাঠানো, সাময়িক আশ্রয় দেওয়াসহ অন্যান্য সহায়তা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। ফলে ফেরত আসা নারী, নারীর পরিবার ও সৌদি আরব থেকে ফিরতে ইচ্ছুক নারীর সঙ্গে মুঠোফোনে আল-আমিনকে অবিরাম কথা বলতে হয়।
আল-আমিন বলেন, ‘এমনও হয়, দিনে প্রায় ১০০টি ফোন রিসিভ করি।’
ফোনে এত কথা বলা, সরাসরি সমস্যার কথা জানা—এসবে বিরক্ত লাগে না? জবাবে আল-আমিন বলেন, ‘তাঁরা (ভুক্তভোগী) অসহায় বলেই তো আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের সমস্যা কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার নিজেরও কাউন্সেলিং দরকার। বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলতে পারি না।’
কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে আল-আমিন বলেন, ফেরত আসা নারী শ্রমিকেরা নাকি মিথ্যা কথা বলেন মর্মে সরকারি প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন। এই নারীরা মিথ্যা বলেন কি না, তা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বললেই বোঝা যেত।
জানা গেল, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে আল-আমিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ—নারী শ্রমিকদের নিয়ে আল-আমিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আল-আমিন বলেন, ‘এই নারীদের অনেকেই দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। তখন তাঁরা পরিবার কিংবা সরকারের কাছে সমাদৃত ছিলেন। কিন্তু যখন তাঁরা বিপদে পড়েছেন, তখন কেউ আর তাঁদের দায় নিতে চাইছে না। এ নিয়ে কেউ আওয়াজও করে না।’