এক দিনের ঢাকা সফর ওঁদের

পবিত্র শবে বরাতের রাতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে ভিক্ষা করতে আসেন এই ভিক্ষুকেরা। ছবিটি আজিমপুর কবরস্থান থেকে তোলা। ছবি: মনিরুল আলম
পবিত্র শবে বরাতের রাতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে ভিক্ষা করতে আসেন এই ভিক্ষুকেরা। ছবিটি আজিমপুর কবরস্থান থেকে তোলা। ছবি: মনিরুল আলম

আষাঢ়ের তপ্ত দুপুর। ভাপসা গরমে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ ছুটছে কবরস্থানে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিশ্বাস, আজকের দিবাগত রাতটি বড় পুণ্যের। সারা রাত ইবাদত-বন্দিগিতে ব্যস্ত থাকবেন, কবর জিয়ারত করবেন, দান-খয়রাত করবেন। এই একটি দিনের আশায় থাকেন হতদরিদ্ররাও। দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা জড়ো হন কবরস্থানে।   
আজ সোমবার রাজধানীর আজিমপুর, বনানী ও মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নারী, শিশু, বৃদ্ধ—সব বয়সের ভিক্ষুকের দেখা মেলে। আজিমপুর কবরস্থান-লাগোয়া সাইনবোর্ডের দোকানি মো. মনির বললেন, রাতের বেলা ভিক্ষুকদের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। অবশ্য সকাল থেকেই বয়সী ভিক্ষুকেরা অয়েল ক্লথ, পাটি নিয়ে জায়গা নির্ধারণ করে রেখেছেন। জোহরের নামাজের পর থেকে দেখা গেল কেউ গাড়ির কাচ ভেদ করে সালাম পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউবা লাঠিতে ভর করে হাতের ইশারায় টাকা চাইছেন। তাঁদের অনেকেই বছরের অন্যান্য সময় টুকটাক কাজ করেন, কেউ চেয়েচিন্তে খান, অনেকে আবার ঢাকার বাইরে থাকেন। কেন এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, পেটেভাতে জীবন তাঁদের। শবে বরাতের দিনটাতে হাতে নগদ কিছু টাকাপয়সা পান। তাই দিয়ে কারও পান-সুপারির খরচ মেটে, কেউবা ওষুধ কেনেন।

এক দিনের এই ভিক্ষুকদের একজন মরিয়ম বেগম। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে সেই কিশোরী বয়সে বধূ হয়ে এসেছিলেন। কোন সালে, তা মনে করতে পারেন না। শুধু জানেন, ‘স্বাধীনের’ আগে পা রেখেছিলেন ঢাকায়। স্বাধীনতার পর পঙ্গু স্বামী মারা যান, রেখে যান দুই মেয়ে আর এক ছেলে। চোখের সামনে ছোটবেলাতেই মারা গেল মেয়ে দুটি, ছেলেটি গেল বয়স হলে। এখন তিনি একা। থাকেন ভাষানটেকে। স্থানীয় এক নারী রান্না করা খাবার বিক্রি করেন। তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন মরিয়ম। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া মেলে তাঁর। শেষ ষাটে পৌঁছানো এই নারীকে এখন মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছে; ভাবেন, কাফনের টাকাও তো জুটিয়ে রাখা দরকার। হাত ফাঁকা। কাফনের কাপড়-আতর-লোবানের টাকাটুকু হাতে রেখে দুনিয়া ছাড়তে চান তিনি। তাই আজ জায়গা নিয়েছেন মিরপুর কবরস্থানে। তবে প্রথম আলো ডটকমকে তিনি বলেন, প্রতিবেশীরা যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সে অনুপাতে টাকা জোটেনি। দেড় ঘণ্টায় তাঁর আয় হয়েছে ১২ টাকা। আয় কম হওয়ার জন্য কিছুটা নিজেকেও দুষছেন মরিয়ম। কারণ, দৌড়াদৌড়িতে অন্যদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না তিনি।

রাস্তার ওপর এসব পঙ্গু মানুষ ভিক্ষা করছেন দল বেঁধে। ছবি: মনিরুল আলম
রাস্তার ওপর এসব পঙ্গু মানুষ ভিক্ষা করছেন দল বেঁধে। ছবি: মনিরুল আলম

কবরস্থানগুলোয় আজ ভিক্ষুকদের ঝগড়াঝাঁটি ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই পিছিয়ে পড়ছিলেন। কোনো কোনো ভিক্ষুক আবার অধিনায়কের ভূমিকায় নেমে পড়েন। সবাইকে সারি বেঁধে বসার কথা বলেন তাঁরা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে আসা আলী আকবরের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। তাঁর পা দুটো অচল। কেউ কাছে এসে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে না থাকলে বুঝবেন না আলী আকবরের একচুল নড়ার ক্ষমতা নেই। পাড়াপড়শি তাঁকে স্ত্রী-সন্তানসহ স্টিমারে তুলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি মাল বইতাম খুলনার নিরালা বাজারে। মনে হয় সেদিন ১০০ কেজির ওপর মাল তুলিছিলাম। বর্ষার দিন। পিছলে একেবারে গর্তে। আর চলতি পারিনি। কত ডাক্তার-কোবরেজ কল্লাম। কিছু লাভ হয়নাই।’ তাঁর থালায় দুপুর পর্যন্ত জমেছে ৫২ টাকা। জানালেন, তিনি এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। তাতে কোনোরকমে পেট চলে যায়। আর একটা-দুইটা করে টাকা জমাচ্ছেন মেয়ে মরিয়ম জান্নাতির জন্য। তিনি স্বপ্ন দেখেন, মেয়ে একদিন ‘প্রাইমারি স্কুলের টিচার হবি। অনেক সম্মান পাবি’।   

সাহায্যপ্রাপ্তিতে আজ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন পঙ্গু ভিক্ষুকেরা। তাঁদের কারও হাত নেই, কারও পা নেই। এমনই একজন ইস্রাফিল মিয়া। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। জানালেন, কেবল শবে বারাতের জন্যই তিনি ঢাকায় আসেন। তবে একা নন, মোহাম্মদ নামের এক সহকারীকে এবার সঙ্গে নিয়ে ইস্রাফিল এসেছেন পাশের জেলা নরসিংদীর বানিয়াথল থেকে। বেঁকে যাওয়া দুটি পা দেখিয়ে ইস্রাফিল বলেন, ‘জন্ম থ্যাইক্কাই আমি পঙ্গু। তাই ভিক্ষা কইর্যাই চলে।

03.	কোনো কাজ করতে পারেন না তিনি। তাই ভিক্ষাই এখন তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ছবি: মনিরুল আলম
03. কোনো কাজ করতে পারেন না তিনি। তাই ভিক্ষাই এখন তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ছবি: মনিরুল আলম

তয় শবে বরাইতে ঢাকা আইল্যে সাহায্য একটু বেশি পাই। এইহানে আজ যা পাওনের পামু।’ ঢাকা আসতে টাকা জোগাড় করতে হয়েছে জানিয়ে ইস্রাফিল বলেন, ‘মোহাম্মদকে লইয়্যা ট্রেনে করে গতকাল (রোববার) সকালে কমলাপুর ইস্টিশন আহি। ওখান থাইক্যা এহানে (মিরপুর) আইতে সিএনজিঅলা ৩০০ টাকা লইছে।’ আগামীকাল (মঙ্গলবার) সকাল পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ঢোকার পাশের রাস্তাতেই শুয়ে সাহায্য চাইবেন ইস্রাফিল। তিনি জানান, এই করবস্থানের পাশে মিরপুর শাহআলী মাজার থাকায় রাতে এখানে মানুষের ঢল নামবে। সে জন্য এখানে সব সময় রোজগার ভালোই হয়।
এই এক দিন যে টাকা পাবেন, তাতেই গ্রামে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটবে। ভিক্ষা করেই সংসার সাজিয়েছেন। তবে দুঃখের কথা, তাঁর ১২ বছরের মেয়েটিও বাবার মতো পঙ্গু। শবে বরাতের এই সময় গতবার কত টাকা আয় করেছিলেন, সে ব্যাপারে মুখ খোলেননি তিনি। কেবল একচিলতে হাসি ফুটেছে ইস্রাফিলের মুখে। কথায় কথায় জানালেন, ভিক্ষার টাকা সঞ্চয় করে তিনি একটি ছোট বাড়ি বানিয়েছেন নরসিংদীতে।

(প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন শেখ সাবিহা আলম, রিয়াদুল করিম ও কমল জোহা খান)