এক বছরে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ মাত্র ৩৩%

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে বিআইডব্লিউটিএ। রোববার কেরানীগঞ্জের মধ্যেরচর খেয়াঘাট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

এক বছরে সারা দেশের নদী দখলদারদের মাত্র ৩৩ শতাংশ উচ্ছেদ করা গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নিজেই বলেছে, প্রত্যাশিত পর্যায়ে উদ্ধারকাজ হয়নি। নানামুখী চাপে অনেক জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান বেশি দূর এগোয়নি। আবার একই অববাহিকা অঞ্চলের সব নদীতে একসঙ্গে অভিযান না হওয়ায় উচ্ছেদের সুফলও আসেনি।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, দখলমুক্ত করার পর অনেক জায়গা ইতিমধ্যে আবারও অবৈধ দখলে চলে গেছে। সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
এখন পর্যন্ত দেশের আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্ছেদ হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। আর সবচেয়ে বেশি ঢাকায়।

দেশের প্রায় সব নদ-নদীতেই পড়েছে দখলদারদের হাত। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সারা দেশে ৫৭ হাজার ৩৯০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। গত বছর নদীর জায়গা দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়ে গত বছরের ২৭ আগস্ট সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় কমিশন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সব জেলায় উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে দিয়েছেন, যাতে নদী দখলের চিত্র কমিটির নজরে আসে, প্রয়োজনে সংসদে আলোচনা করতে পারেন এবং সরকারের আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, নদীর সীমানা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে কমিশনের সুপারিশ আছে। তিনি বলেন, করোনাকালে লকডাউনের কারণে পুরোদমে উচ্ছেদকাজ হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ বা জেলা প্রশাসনের প্রয়োজনীয় লোকবল–সংকট, অর্থ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব আছে। এসব উত্তরণে করণীয় নিয়ে কমিশন চিন্তাভাবনা করছে।

তবে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা বলছেন, নদীর সীমানা চিহ্নিত না করে উচ্ছেদ অভিযান চালালে তা ফলপ্রসূ হয় না। তাই উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগে দরকার উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত করা।

চলতি মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে মোট অবৈধ দখলদারের ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ উচ্ছেদ করা গেছে। সবচেয়ে বেশি অবৈধ উচ্ছেদ হওয়া ঢাকা বিভাগে মোট ৮ হাজার ৫১০ অবৈধ দখলদারের মধ্যে ৬ হাজার ৯৩১ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখানে দখল উচ্ছেদের হার ৮১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

চলতি মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে মোট অবৈধ দখলদারের ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ উচ্ছেদ করা গেছে। সবচেয়ে বেশি অবৈধ উচ্ছেদ হওয়া ঢাকা বিভাগে মোট ৮ হাজার ৫১০ অবৈধ দখলদারের মধ্যে ৬ হাজার ৯৩১ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখানে দখল উচ্ছেদের হার ৮১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জেলাভিত্তিক হিসাবেও সবচেয়ে বেশি দখলমুক্ত হয়েছে ঢাকা জেলা ও মহানগরীর চারপাশে। এখানে ৯৫৯ জন অবৈধ দখলদারের ৫ হাজার ৭৯৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।

সবচেয়ে কম উচ্ছেদ হওয়া চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীতে ১৮ হাজার ৫৩৭ জন দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৩৫১ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে উচ্ছেদের হার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বরিশালে উচ্ছেদ হয়েছে ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ, সিলেটে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৩৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রংপুরে ৩৭ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং খুলনায় উচ্ছেদের হার ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদী রক্ষায় উচ্ছেদ ও উদ্ধার, পানি ও পরিবেশদূষণ প্রতিরোধের দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্রায়োগিক আইনি ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় জনবল, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জেলা–উপজেলা প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। কালেক্টর, রাজস্ব কর্মকর্তা, বিআইডব্লিউটিএ বা পাউবো—যারা নদীর জমি ব্যক্তি গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে লিজ, দখল হস্তান্তর করেছে, তাদের দ্বারা উচ্ছেদ বা উদ্ধারকাজ শুরু করানো গেলেও প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও অবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তন বা উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়নি। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানামুখী চাপের মোকাবিলা ও সীমাবদ্ধতার কারণে বেশি দূর এগোতে পারেনি।

নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নদ–নদীর তীর ও প্লাবনভূমিতে অবৈধভাবে নির্মিত সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদের বাস্তবায়ন ও আইন মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএকে বারবার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অনেক জেলার নদ-নদীর ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হয়নি। যেমন বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে শুরু হলেও নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ও শীতলক্ষ্যায় এমনকি ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র নদেও উচ্ছেদ করা যায়নি। ফলে একই অববাহিকাঞ্চলে নদ–নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধারে এবং ভাটিপথে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যার পানি দ্রুততার সঙ্গে নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি। বরং জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, যা জনদুর্ভোগ কমাতে বা ভুক্তভোগীদের কষ্ট লাঘব করতে পারেনি।

৬ ডিসেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে নদী উদ্ধারে সমস্যা ও ধীরগতির কারণ চিহ্নিত করতে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সংসদীয় কমিটি।

যেসব জায়গা ইতিমধ্যে দখলমুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্যাকেজ টেন্ডার হয়েছে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে প্রায় ৮০ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, নৌপরিবহনমন্ত্রী

উচ্ছেদের পর আবার দখল

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে রাজধানীর চারপাশে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগকে ঘিরে। সরকারদলীয় দুজন সাংসদের দখলে থাকা জায়গাও এখানে উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর নদীর সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। তবে তুরাগপাড়ে কিছু জায়গা এখন আবার অবৈধ দখলে চলে গেছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তুরাগ থানার প্রত্যাশা সেতু থেকে ধউর সেতু পর্যন্ত ২২৫টি স্থাপনা উচ্ছেদসহ ৩ দশমিক ৫ একর জায়গা দখলমুক্ত করা হয়। এর অধিকাংশই আবার বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে ধউর এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেলের সামনে ও তার আশপাশের এলাকায় নদের জায়গায় আবারও গড়ে উঠেছে বিশাল ট্রাকস্ট্যান্ড। কিছু কিছু অংশে নদ ভরাটের কাজও চলছে।

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিছুদিন পর সেখানে আবার দোকানপাট বসে। এরপর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ও ২৪ আগস্ট আরও দুই দফা অভিযান চালানো হয়। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে আবার দোকানপাট গড়ে উঠেছে।

রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় নদের প্রায় ১০ একর জায়গায় গড়ে উঠেছিল স্লুইসগেট নামে একটি কাঁচাবাজার। বাজারটিতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০টি দোকান ছিল। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাজারটিতে অভিযানে যায় বিআইডব্লিউটিএ। ২৩ ডিসেম্বর অভিযান চালানো হয় ঢাকার আবদুল্লাহপুরের একটি মাছের আড়তে। সেখানেও নদের জায়গায় গড়ে উঠেছিল ৬০০ থেকে ৭০০ দোকান। পরে দুটো বাজার থেকেই এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এখন সেখানে আবার দোকানপাট গড়ে উঠেছে।

নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যেসব জায়গা ইতিমধ্যে দখলমুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্যাকেজ টেন্ডার হয়েছে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে প্রায় ৮০ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। করোনার কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল। কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে কিছু দোকানপাট, ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। সেগুলো অস্থায়ী। নারায়ণগঞ্জে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। দীর্ঘদিন ধরে এ জায়গাগুলো অবৈধ দখলে আছে। এর আগে অন্য সরকার উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়নি। এখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবাইকে বুঝিয়ে, আলাপ–আলোচনা করে কাজ করতে হচ্ছে। অনেকে আদালতেও যাচ্ছেন। তিনি বলেন, তাঁরা সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন, যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। সম্প্রতি পুরান ঢাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নদী দখল করে বিদ্যুৎকেন্দ্র, কারখানা

সম্প্রতি নদী রক্ষা কমিশন কয়েকটি নদী পরিদর্শন করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের মিলনস্থলের কাছে স্লুইসগেট বন্ধ করে নির্মাণ করা হচ্ছে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্লাবনভূমিসহ নদী ও নদীর জায়গা দখল করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর তীরে সক্রিয় প্লাবনভূমিতে তৈরি হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানে নদীর জায়গায় গড়ে উঠেছে ছয়টি হাটবাজার। জামালপুরেও নদীর জায়গা করে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের ১৫ একর জায়গা দখল করে করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীর জায়গা দখল করে দোকানপাট, হাটবাজার, ইটের ভাটা, বসতবাড়ি থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। ইকোনমিক জোন করার জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ নদীর জায়গা ভরাট করছে। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে শিপইয়ার্ড ও কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা।

প্রতিবেদনের তথ্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, আগে নদীর সীমানা চিহ্নিত না করে যে উচ্ছেদপ্রক্রিয়া, তা ত্রুটিপূর্ণ। এর মাধ্যমে অনেক অবৈধ দখলদার বৈধতা পান। শুরু থেকেই তাঁরা এ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁরা চান উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আগে সব নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হোক। এরপর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।