এক বছরে দুবার ঘর ভাঙল

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কয়েকটি খাবারের হোটেল ও দোকান। ছবিটি জেটিঘাট এলাকা থেকে গতকাল সকালে তোলা l প্রথম আলো
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কয়েকটি খাবারের হোটেল ও দোকান। ছবিটি জেটিঘাট এলাকা থেকে গতকাল সকালে তোলা l প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে গত বছর এই মে মাসেই বসতঘর তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শাহ আলমের। ঝড়ের তাণ্ডবে তখন প্রাণ হারায় তাঁর মেয়ে মারজান (৩)। মেয়ের শোক বুকে নিয়ে ভাঙা ঘর আবার মেরামত করে নতুন জীবন শুরু করেন তিনি। কিন্তু এক বছরের মাথায় আবার তাঁর ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে তাঁর ঘরের ছাউনি উড়ে যায়।

মোরার আঘাতে শাহ আলমের ঘরসহ খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রায় তিন শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরো বাঁশখালী উপজেলায় ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত দুই হাজার ঘর। ঝড়ে গাছ পড়ে আহত হয়েছে সাতজন। তাদের বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

বাঁশখালীর উপকূলীয় ইউনিয়ন খানখানাবাদ, ছনুয়া, গণ্ডামারা ও শেখেরখিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। বড় বড় গাছ ভেঙে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এলাকার যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা। পাশের উপজেলা আনোয়ারায়ও ঝড়ে এক হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান।

বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নটির অবস্থান সাগরের কূল ঘেঁষে। ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া বাজারের শেষ সীমানায় বেড়িবাঁধ। গত বছর রোয়ানুর আঘাতে এই ইউনিয়নের সাতজন মারা যায়। তখন বাঁধটি ছিল না। নতুন দেওয়া এই এই বাঁধের কারণে এবার পানি ঢুকতে পারেনি। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে বলে জানান খানখানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বদরুদ্দিন। গতকাল বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অসহায় মানুষকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার (চিড়া, গুড়) বিতরণ করা হচ্ছে।

সরেজমিনে গতকাল দুপুরে খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া এলাকায় দেখা যায়, ঘর মেরামতের কাজ শুরু করছেন জেলে মো. শাহ আলম। প্রচণ্ড বাতাসের কারণে ঘরের চালে লাগানো পলিথিন বারবার উড়ে যাচ্ছিল। তাঁর পাশের ঘরটি আবদুল মোমেনের। ঘরের টিনের ছাউনি উপড়ে পড়ে আছে উঠোনে।

আবদুল মোমেন বলেন, তাঁর তিন ছেলে। দুই ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। বড় ছেলে মাছ ধরে। গত ঝড়ে ঘর পানিতে তলিয়ে যায়। এবার চালা উড়ে গেছে।

প্রেমাশিয়ার পাশের গ্রাম রায়ছটা। এই গ্রামের বাসিন্দা বেলাল হোসেনের ঘরের ছাউনির নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে একটি হাঁস। তিনি বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে ঘরের টিনের চাল পাল্টেছিলেন।

বাঁশখালীর প্রধান সড়কের মনচুরিয়া বাজার, দারোগা বাজার ও বানীগ্রাম বাজারে গাছ পড়ে যান চলাচল ব্যাঘাত ঘটে। বাঁশখালীর উপজেলা আদালতের অস্থায়ী ভবনের ওপর বড় গাছ ভেঙে পড়ে।

উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে ভোরে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাই। ঝড় থামার পর এসে দেখি ঘরটি ভেঙে গেছে।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ইউনিয়নে আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ টাকার শুকনা খাবার বিতরণ করছেন তাঁরা।

বাঁশখালী পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয় সূত্র জানায়, ঝড়ে ১৫টির মতো খুঁটি ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন ছিঁড়ে যাওয়ায় উপেজলার বেশির ভাগ এলাকা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিল।

শেখেরখীল ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিন বলেন, চারটি মাছ ধরার ট্রলার ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে পারেনি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত তা জানতে পারেননি তাঁরা।

বাঁশখালী উপজেলা কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী মোহাম্মদ চাহেল তস্তরী বলেন, ঝড়ে উপজেলায় কেউ নিহত হয়েছে, এমন খবর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাননি তাঁরা।

আনোয়ারা

ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২১৫টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট শতাধিক ঘর। গাছ উপড়ে পড়ে পুরো উপজেলার বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাত নয়টা পর্যন্ত উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিল। ঝড় থামার পর গতকাল দুপুরের দিকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছেন।

আনোয়ারা ইউএনও গৌতম বাড়ৈ প্রথম আলোকে বলেন, গাছ পড়ে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রশাসনের উদ্যোগে গাছ সরিয়ে বিকেলের মধ্যে প্রধান সড়কগুলো যান চলাচলের উপযোগী করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।

চট্টগ্রাম মহানগর

ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় প্রায় ১০০ দোকান বিধ্বস্ত হয়েছে। সকাল পৌনে আটটা থেকে দমকা হাওয়ার কারণে নগরের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়ে। পরে সিটি করপোরেশনের কর্মী ও স্থানীয় লোকজন ভেঙে পড়া রাস্তা থেকে সরিয়ে নেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় পতেঙ্গা ও দক্ষিণ হালিশহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ আতিকুর রহমান বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নগরের বিভিন্ন স্থানে গতকাল সকাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয় বলে জানান পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন। তিনি বলেন, ঝড়ে বিদ্যুৎ লাইনের ওপর গাছপালা ভেঙে পড়ার কারণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। দুপুরের পর থেকে ধীরে ধীরে নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আনোয়ারা প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন ও বাঁশখালী সংবাদদাতা হিমেল বড়ুয়া)