একজন সন্‌জীদা খাতুন

সন্‌জীদা খাতুন আজ বৃহস্পতিবার ৯২ বছরে পা রাখলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তিনি অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়ে ২০২০ সালে এই লেখাটি ‘সন্‌জীদা খাতুন সম্মাননা স্মারক: বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর জন্মদিনে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।

সন্‌জীদা খাতুন (জন্ম: ৪ এপ্রিল ১৯৩২)
প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

এক.
আজকাল ষাটের দশকের সময়গুলোর কথা খুব ভাবি। মনের ভেতরে-বাইরের স্মৃতিগুলো গভীরভাবে লালন করে চলেছি। ষাটের দশকের পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পথের সেই দিনগুলো-রাতগুলোর কথা কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

সন্‌জীদা খাতুন, আমাদের সন্‌জীদা আপার কথা ভাবতে ভাবতেই সেই ষাটের দশকের অনেক কথা, অনেক স্মৃতি বলতে ইচ্ছে হলো।

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সে সময়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় যে সাহসী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটেছিল, সেটাই পরে ষাটের দশকজুড়ে বহু বিস্তৃত হয়ে দেশে অবিশ্বাস্য এক গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এসবের পেছনে দেশের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক (আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি) দলগুলোর বিরাট ভূমিকা ছিল। একই সঙ্গে সে সময়ের প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলো (ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ প্রভৃতি) যৌথভাবে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই সবকিছুই শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের এক ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে সব প্রস্তুতিতে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিল।

আবার এই ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি আরেকটি গভীর স্রোতোধারাও বহমান ছিল, আর সেটা ছিল বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও বাঙালির সংস্কৃতির জন্য অব্যাহত সংগ্রাম। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সে সময় একাধিক কমিটি করে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।

রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান পালনের পরপরই সংগঠক ও শিল্পীরা সবাই মিলে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন আনন্দ-উৎসব করতে। সেখানেই বিকেলের আসরে মোখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া) প্রস্তাব করলেন, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই একমত হলে নতুন সংগঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। সুফিয়া কামাল সভাপতি ও ফরিদা হাসান সাধারণ সম্পাদক। কমিটিতে আরও ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সায়েদুল হাসান, শামসুন্নাহার রহমান, ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক প্রমুখ। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্‌জীদা খাতুনের নাম প্রস্তাব হলেও তিনি কমিটিতে থাকেননি। তিনি তখন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। নবগঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক হয়েছিল ‘ছায়ানট’।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনে ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুন
ফাইল ছবি

সন্‌জীদা খাতুনকে জীবনের প্রায় শুরু থেকে দেখা গেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। যখন তিনি কলেজের শিক্ষার্থী, তখন থেকেই পড়াশোনা, আবৃত্তি ও অভিনয়ের পাশাপাশি গানের চর্চা করেছেন। পাশাপাশি কিছু সাংগঠনিক কাজেও যুক্ত হয়েছেন।

শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মুকুল ফৌজে কাজ করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। তাঁর প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান এবং পল্লিগীতি। পরে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন হুসনে বানু খানমের কাছে। পরে আরও অনেকের কাছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনসহ কয়েকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সন্‌জীদা খাতুন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে বাসায় ফিরে ছাত্রহত্যার খবর পেয়েছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সবকিছু বন্ধ, সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নানা খোঁজখবর নিয়ে বিকেলে মাকে নিয়ে রওনা দিলেন অভয় দাস লেনের এক বাসার উদ্দেশে মহিলাদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে। সেই ভয়ের পরিবেশে দূর পথ হেঁটে গেলেন সে বাসার চত্বরে। সেখানে গিয়ে দেখেন বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ উপস্থিত। কিন্তু সেদিন সে পরিস্থিতিতে কেউ সভার সভাপতি হতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সন্‌জীদা আপার মা সাজেদা খাতুনকে সভাপতির আসনে বসিয়ে দিলেন। মা গুটিসুটি হয়ে বসে থাকলেন। অন্যরা বক্তৃতা করলেন। সেদিন সন্‌জীদা খাতুন প্রথম বক্তৃতা করলেন। শুরুতেই ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর কথায় ‘দু-এক লাইনের’ বক্তৃতা দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’

সে সময় আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। দুটি সরকারি স্কুল—বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। তার প্রতিবাদে নতুন সংগঠন ‘ছাত্রী সংসদের’ উদ্যোগে পল্টন ময়দানে জনসভা ডাকা হয়েছিল। এই সভার একজন উদ্যোক্তা ছিলেন সন্‌জীদা আপা। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান। একে একে নেতারা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। শুরু থেকে সভা পরিচালনার কাজটি চলে গেল ছাত্রলীগ নেতা এম এ ওয়াদুদের হাতে। তাতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আবদুস সাত্তারের আপত্তি। এ অবস্থায় সন্‌জীদা খাতুন নিজে মঞ্চে উঠে সভা পরিচালনা শুরু করলেন। কিছুটা গোলমাল করার চেষ্টা হলো। কিন্তু সন্‌জীদা আপার বলিষ্ঠ আওয়াজে সব থেমে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে অনার্সের পর শান্তিনিকেতনে যাবেন, বিশ্বভারতীতে এমএ পড়বেন। হয়েছিল তা-ই।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ
ফাইল ছবি

দুই.
বাংলাদেশের এক অনন্য সংগঠন ছায়ানট। আমরা জানি, শুরুর দিন থেকেই ছায়ানটের একেবারে সামনের সারির মানুষ ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। ৫৮ বছর ধরে ছায়ানট বাংলাদেশে একটি মানবিক বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে চলেছে। এখনো সামনে আছেন সন্‌জীদা খাতুন।

ছায়ানট গঠনের পর আবদুল আহাদের পরিচালনায় পুরোনো গানের এক বড় সফল অনুষ্ঠান হয়েছিল। পরে শুরু হলো শ্রোতার আসর। প্রথম আসরে গান গেয়েছিলেন শিল্পী ফিরোজা বেগম। তাঁর পরের শিল্পী ছিলেন ফাহমিদা খাতুন। তারপরও কিছু অনুষ্ঠান হলো। একসময় প্রশ্ন দেখা দিল, এত শিল্পী কোথায়? তখনই গানের স্কুল করার কথা হলো এবং ১৯৬৩ সালে শুরু হলো ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। ওয়াহিদুল হক ছিলেন এর পেছনের মূল উদ্যোক্তা। এরপর ছায়ানট আর থেমে থাকেনি। দশকের পর দশক ধরে ছায়ানট নানা সময়ে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে বা সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তার সাহসী পথচলা অব্যাহত রেখেছে।

সেই ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদও দেশজুড়ে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করেছে। ওই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মনে এ বিশ্বাস ছিল যে দেশকে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারায় নিতে হলে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। এ ভাবনা থেকে বছরের পর বছর ডাকসুর একুশে ফেব্রুয়ারির বড় অনুষ্ঠান, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন বা নানা উপলক্ষে ছোট-বড় নানা আয়োজনে গান, নাচ বা নাটক হতো। সে সময়ে দেশের সেরা গায়ক বা অভিনেতারা এতে অংশ নিতেন। এসব অনুষ্ঠানে শুধু দেশের গান বা গণসংগীত হতো। সেই ষাটের দশকজুড়ে আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন শেখ লুৎফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অজিত রায়, জাহেদুর রহীম, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন প্রমুখ। শুরুতে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী এবং পরে মাহমুদুন্নবী প্রমুখ। সঙ্গে ছিলেন নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আমাদের সংগঠনের শিল্পীরা। তাঁদের অনেকের কথা এখনো মনে পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটক করা হয়েছিল দুবার। একবার মাসুদ আলী খান ও অন্যবার হাসান ইমাম পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমিতে ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গোলাম মুস্তাফা। এই নাটক দেখতে সেদিন বিপুল দর্শকসমাগম হয়েছিল এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলাম। আরও যাঁরা নানা সময়ে অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা পরে সবাই তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। যেমন আবুল হায়াত, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, গোলাম রাব্বানী, ইনামুল হক, লায়লা হাসান, কাজী তামান্না, লাকী ইনাম প্রমুখ। ‘তাসের দেশ’ ও ‘রক্তকরবী’ নাটকে সংগীত আয়োজন ও অন্যান্য কাজে সন্‌জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হক অনেক সাহায্য করেছিলেন।

বাংলাদেশের এক অনন্য সংগঠন ছায়ানট
ফাইল ছবি

ষাটের দশকের শেষার্ধে প্রতিষ্ঠিত সেরা গায়কদের বাইরে তখন তরুণ ইকবাল আহমেদ, বেলা ইসলাম, শাহীন সামাদ, মিলিয়া গণি, ইফফাত আরা দেওয়ানসহ অনেকে সক্রিয়ভাবে আমাদের সংস্কৃতি সংসদের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। ইকবাল তো সত্তরের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইকবাল আহমেদ শুধু রবীন্দ্রসংগীত করতেন না, পরে তিনি খুব ভালো গণসংগীতও করতেন। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রধান অনুষ্ঠান ছাড়াও আমাদের অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। ইকবাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা কারাগারে নির্যাতিত হয়েছিলেন। তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন ছায়ানটের ছাত্র।

ভুল না হলে, ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের তিন দিনের সম্মেলনে দুই সন্ধ্যায় হয়েছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথম অনুষ্ঠানে ছিল রবীন্দ্রনাথসহ অন্যদের দেশের গান। পরে হয়েছিল ‘তাসের দেশ’ নাটক। দ্বিতীয় দিন গণসংগীতের অনুষ্ঠান। পরিচালনা করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। পরে হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ গানের নৃত্যানুষ্ঠান। মনে পড়ছে, নজরুলের জন্মশতবার্ষিকীতে ছায়ানটের উদ্যোগে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। আলতাফ মাহমুদের পরিচালনায় দেশের সেরা শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের জন্য আলতাফ মাহমুদ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার একটি নতুন সুরারোপ করেছিলেন। সেই গানের সুরেই নৃত্য পরিচালনা করেছিলেন সে সময়ের আলতামাস আহমেদ। এই দুই দিনের অনুষ্ঠান সে সময় বিপুল সাড়া ফেলেছিল।

সেই ষাটের দশকের ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ), সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা আন্দোলনের প্রায় সব উদ্যোগে আমরা সব সময় সন্‌জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হককে ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছি। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের লড়াইয়ে ছায়ানট, ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটা ঐকতানের সুর খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা হয়েছিল সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, সহমর্মিতা ও সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। আমাদের দেওয়া-নেওয়ার পাল্লা ভারী ছিল সন্‌জীদা আপা, ওয়াহিদুল ভাই ও ছায়ানটের দিকেই বেশি। আমরা ছোট-বড় যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য সাহায্য চাইতে এই দুজনের কাছে গিয়েছি অনেক। কোনো দিন শূন্য হাতে ফিরে আসিনি।

ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ডাকসুর উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির সময়। সেবারই প্রথম শহীদ মিনারে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল। পুরো অনুষ্ঠানের সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তবে পুরো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির সঙ্গে ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও কামাল লোহানী। ধারাবর্ণনা লিখেছিলেন জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক বদরুল হাসান (শিল্পী কামরুল হাসানের ভাই)। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন জাহেদুর রহীম, ফাহমিদা খাতুন, অজিত রায়, লায়লা সারোয়ারসহ অনেকে। মনে আছে, ওই অনুষ্ঠানের রিহার্সেলে আলতাফ মাহমুদ ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’ গানটি অজিত রায়কে যখন শেখাচ্ছিলেন, তখন অদ্ভুত এক বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও আমাকে উদ্দীপ্ত করে। এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ও অন্যান্য কাজে বন্ধু আবুল হাসনাত ও আমি সারা সময়ের জন্য যুক্ত ছিলাম। সেবারই ওয়াহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়।

তিন.

সন্‌জীদা খাতুনের সঙ্গে পরিচয় বা যোগাযোগের প্রথম স্মৃতি মনে নেই। তবে আমরা সে সময়ে, ষাটের দশকের দিনগুলোতে ছায়ানটের প্রায় সব অনুষ্ঠানে যেতাম। মনে পড়ে, র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটের বলধা গার্ডেনে ছায়ানটের প্রথম শারদ উৎসবের অনুষ্ঠানে সকালবেলায় হাজির হয়েছিলাম। প্রথম বসন্ত উৎসব হয়েছিল জগন্নাথ হলের বাঁ দিকের কোনো একজন অধ্যাপকের বাসভবনের সবুজ চত্বরে। এ ছাড়া শ্রোতার আসরের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি। নানা কাজে ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে (পরে উদয়ন স্কুল) ছায়ানট শিক্ষায়তনে গিয়েছি অনেকবার। ছায়ানটের সেসব অনুষ্ঠানে নিজেদের শিল্পীদের বাইরেও বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, কলিম শরাফী, অজিত রায়ের গানও শুনেছি। আলতাফ মাহমুদকে পেছনে বসে একটি-দুটি অনুষ্ঠানে বেহালা বাজাতে দেখেছি। এসবের মধ্য দিয়েই সন্‌জীদা আপার সঙ্গে পরিচয় ও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার এখনো মনে পড়ে, ইত্তেফাক-এর সহকারী সম্পাদক আহমেদুর রহমান ১৯৬৫ সালে কায়রোতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে সন্‌জীদা খাতুন প্রচণ্ডভাবে শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবরের পর আমরা আহমেদুর রহমানের বাসায় গিয়ে সন্‌জীদা আপাকে কান্নারত অবস্থায় দেখেছিলাম। পরে আহমেদুর রহমান স্মরণে ছায়ানটের আলোচনা সভা ও গানের অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় প্রবল বৃষ্টি ছিল। তার মধ্যে সে অনুষ্ঠানে রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠে আবেগসঞ্চারী প্রবন্ধ পড়েছিলেন। আমরা খুব উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম সেদিন।

মনে পড়ে, নানা কাজের সূত্রে সে সময়ের কিছু বামপন্থী নেতা ও কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সন্‌জীদা খাতুনের। স্বল্প সময়ের জন্য কারও কারও গোপন আস্তানা ছিল তাঁর বাসা। সেই পঞ্চাশের দশকের কোনো এক সময়ে আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জি তাঁদের বাসায় থেকেছেন। সে সময়ের আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খোকা রায়ের স্ত্রী যুঁইফুল রায়, কখনো আয়েশা বা কখনো রাবেয়া পরিচয় ছিল, তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। তো একদিন তিনি এসে পল্টন ময়দানে শুধু মহিলাদের নিয়ে সভা করার জন্য সন্‌জীদা আপাকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন। ইতিমধ্যে বিএ অনার্স পাস করে সন্‌জীদা আপা শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন স্থির করে ফেলেছেন। এ সময় যুঁইফুল রায় এসে সন্‌জীদা আপাকে বললেন, ‘ওখানে গিয়ে কী করবে? পার্টির সদস্যপদ নাও। এখানেই কাজ করো।’ তিনি এ কথা শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘সেটা আমি পারব না।’ আরও বললেন, তিনি গান ছাড়তে পারবেন না। নিজের বিচার-বিবেচনা বাদ দিয়ে পার্টির নির্দেশ মেনে চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। পরে সন্‌জীদা আপা লিখেছেন, দলভুক্ত হওয়া মানে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া। তাঁর আত্মজীবনী সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দেতে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে, বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’ এখনো তিনি সেই নিজস্ব কাজের ধারা থেকে বিচ্যুত হননি। আজীবন তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে মাঠে স্থির আছেন। ছায়ানট শুধু নয়, তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় বা কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখনো সামনে থেকে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছেন। আসলে সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের বাংলাদেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনে ছিলেন তিনি। সেদিন সকালের কথা কোনো দিন ভুলিনি। সেদিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল, বাংলা সনের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। রমনার বটমূলে ছায়ানট প্রথম আয়োজন করেছিল নববর্ষের প্রথম অনুষ্ঠানের। সে অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। আমরা ৩১/১ হোসেনি দালান রোডের কার্যালয়ে সারা রাত জেগে ও আশপাশ থেকে কিছু ফুল, কিছু গাছের পাতা-ডালসহ কিছু বেলুন নিয়ে ১০০-১৫০ ছাত্র মিছিল করে ছায়ানটের প্রথম পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলাম। সামনে ছিল ব্যানার ‘এসো হে বৈশাখ/ এসো এসো’। সেদিনের দর্শক-শ্রোতা হাততালি দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত করেছিলেন। সেদিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেক্স ভবনের বলাইয়ের ক্যানটিনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন। সন্ধ্যা সাতটায় বাংলা একাডেমির মাঠে সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে সংগীতানুষ্ঠান হয়েছিল। সন্‌জীদা খাতুনের স্বাধীনতার অভিযাত্রায় গ্রন্থের ‘বাঙালি অন্তরের নববর্ষ’ লেখায় এসব তথ্য রয়েছে।

সন্‌জীদা খাতুনকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেছে ভারত সরকার
ছবি: সংগৃহীত

আমার আরও মনে আছে যে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ছায়ানট বিদ্যায়তনে (ফুলার রোডের উদয়ন স্কুলে) নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছে নিয়মিত। প্রথমবার এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছায়ানট বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর (১৯৬৭ সাল থেকে) ৫২ বছর ধরে (শুধু একাত্তর সাল বাদ দিয়ে) ছায়ানট রমনার বটমূলে এই নববর্ষের বড় অনুষ্ঠান সফলভাবে করে চলেছে। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ২০০১ সালে নববর্ষের প্রভাতের এই অনুষ্ঠানে বড় রকমের জঙ্গি হামলা হলেও ছায়ানট বা সন্‌জীদা খাতুন এই অনুষ্ঠান থেকে সরে আসেননি। বরং আরও ভালোবেসে এই অনুষ্ঠান করে চলেছেন আজ অবধি। এই বিশাল সফলতার সামনে প্রথমে আছেন সন্‌জীদা খাতুন, যিনি অক্লান্ত এই মহৎ উদ্যোগে সর্বদা সক্রিয় থেকেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এখানে আমার একটি ভাবনার কথা বলি। সেটা হলো, সন্‌জীদা খাতুন সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ না করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবার এ কথা সত্য যে ষাটের দশকজুড়ে ছায়ানট বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজে সে সময় বামপন্থী ছাত্র, বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক কর্মীদের তিনি তাঁর পাশে পেয়েছেন। তিনিও তাঁদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাঁদের দিকে হস্ত প্রসারিত করেছেন। ছায়ানট এবং তাঁর জীবনের সব কার্যক্রমে সেটা প্রতিফলিত। আর তাঁর বই লেখা, গান গাওয়া বা সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক ধারাকে প্রভাবিত করেছে, শক্তিশালী করেছে। সে জন্য আমরা, আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের পরের প্রজন্ম তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতের বাংলাদেশও কৃতজ্ঞ থাকবে সন্‌জীদা খাতুনের কাছে।

আরেকটি কথা স্মরণ করতে চাই, দেশের দুজন প্রধান বামপন্থী লেখক ও বুদ্ধিজীবী রণেশ দাশগুপ্ত, বিশেষ করে সত্যেন সেনের প্রতি সন্‌জীদা আপার ছিল অসীম শ্রদ্ধা আর অপার মমতা। আমাদের সত্যেন সেন বহুদিন তাঁর আজিমপুরের বাসায় থেকেছেন। সন্‌জীদা আপা সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। সত্তর-আশির দশকেও শান্তিনিকেতনে বা কলকাতায় সত্যেন সেনকে সময় দিয়েছেন। সেবা করেছেন। সন্‌জীদা খাতুনের ‘স্মৃতিপটে গুণীজন’ গ্রন্থে সত্যেন সেনকে নিয়ে পাঁচটি লেখা রয়েছে। তাঁর বাবা ড. কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আছে চারটি লেখা। আর এ তথ্যও আমার এক বড় বিস্ময় যে সন্‌জীদা আপার তিন ভাইকে পড়িয়েছেন আজীবন বামপন্থী চিন্তাবিদ ও লেখক সরদার ফজলুল করিম। তিনি তাঁদের বাসায় দিনের দুই বেলা আহার করতেন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন তখন ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর।

সন্‌জীদা খাতুন সম্মাননা স্মারক গ্রন্থের প্রচ্ছদ

চার.

প্রায় ষাটের দশকজুড়েই আমরা বামধারার ছাত্ররাজনীতি ও সংস্কৃতি সংসদের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি দুটি সংগঠন—ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের নেতৃত্বের পর্যায়েও কাজ করেছি। অন্যদিকে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীও ছিলাম। আসলে শুধু নানা রকম নয়, সব রকম কাজেই আমরা আনন্দ পেতাম। এসবের মধ্যে বিশেষ করে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলন প্রকাশ এবং সব ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু আমি কোনো দিন কোনো সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিইনি। আমাদের এটা জানা ছিল যে সন্‌জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে আমাদের রাজনীতি ও আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সে জন্য ছায়ানটের নানা কার্যক্রম এবং এই সংগঠনের প্রতি আকর্ষণ ও সমর্থনও সহজাত ছিল। আসলে সেই দিনগুলোতে ছায়ানট তো বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। শুধু সংস্কৃতি কেন, দাঙ্গাবিরোধী কার্যক্রম, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো বহু কাজ করেছে ছায়ানট। এ ধরনের সব কার্যক্রমের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। তাই আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ডা. সারোয়ার আলী, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক, গোলাম মর্তুজা, জামাল আনোয়ার (বাসু)সহ অনেকেই ছায়ানটের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।

মনে পড়ে, সন্‌জীদা আপার আজিমপুরের ফ্ল্যাটে কত কাজে গিয়েছি। আমাদের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গোপন বৈঠকও হয়েছে সে বাসায়। আমি নানা কাজে সন্‌জীদা আপাদের সেগুনবাগিচার বাসায় গিয়েছি অনেকবার—কখনো ফাহমিদা খাতুন (লিনু আপা) বা তাঁদের নিকটাত্মীয় রওশন আক্তারের (জলি আপা) সঙ্গে কোনো কাজে বা কথা বলতে। একবার গিয়েছিলাম, সেটা সম্ভবত ১৯৬৫ সাল হবে, সন্‌জীদা আপার ভাই লেখক ও গায়ক কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে গান গাইতে অনুরোধ করার জন্য। তবে তিনি আসতে পারেননি। অনুষ্ঠানে তাঁর অনুপস্থিতিতে শহীদ মিনারে আলতাফ মাহমুদ গেয়েছিলেন ‘ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি ও বাঙালি’। তাঁর কণ্ঠে গানটি শোনা ছিল জীবনের একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। গানটি তাঁর কণ্ঠে প্রথম শুনেছিলাম আরমানিটোলা মাঠে ১৯৫৪ সালের একুশের অনুষ্ঠানে।

১৯৬৭ সালে একবার সন্‌জীদা আপাকে রিকশায় করে আজিমপুর থেকে সেগুনবাগিচায় তাঁর বাবার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সে দিনের ঘটনাটি ভেবে এখনো আমি লজ্জিত হই। সেবার ছিল আমার এমএ পরীক্ষা। আমার বিষয় ছিল স্ট্যাটিসটিকস। সংগঠন-আন্দোলনের কাজ করতে গিয়ে আসলে কোনো ক্লাস প্রায় করিনি। কোনো পড়াশোনাও হয়নি। লিখিত পরীক্ষায় পার পেয়ে গেলেও মৌখিক পরীক্ষায় কিছুই পারব না, সেটা নিশ্চিত ছিলাম। তো সে পরীক্ষায় বাইরে থেকে পরীক্ষক আসবেন সন্‌জীদা আপার বাবা ড. কাজী মোতাহার হোসেন। সে কথা জেনে সন্‌জীদা আপাকে অনুরোধ করেছিলাম যেন পিতার কাছে আমাকে একটু সহায়তার কথা বলেন, যেন কঠিন প্রশ্ন না করেন—এ রকম কিছু হবে। আপা তাঁর বাবাকে কী বলেছিলেন সেদিন, আমার মনে নেই। তবে পরীক্ষায় পাস করে গিয়েছিলাম। আসলে দিশেহারা হয়েই এমন এক অন্যায্য অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে। আর এটা আমার জন্য বিস্ময় যে সন্‌জীদা আপার মতো একজন কীভাবে এই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। হয়তো আমার মতো একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মীর জন্য মায়া ছিল।

সন্‌জীদা খাতুন
ফাইল ছবি

পাঁচ.

সন্‌জীদা খাতুন, সেই দিনগুলোতে আমরা মিনু আপা বলতাম। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এত কিছু মনে পড়ে গেল। তাঁর লেখা পাঁচ-ছয়টা বই আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আরও কত স্মৃতি আর ভাবনা মনের মধ্যে জড়ো হলো। সেসব নিয়ে বলতে গেলে এই দীর্ঘ রচনা আরও দীর্ঘ হবে। সেটা কেউ ছাপতেও চাইবে না। তাই এ লেখা এখানেই শেষ করতে হবে। শেষের আগে দুটি কথা বলব।

১. ছায়ানট একটি অব্যাহত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চর্চারও একটি কেন্দ্র। এখনো ৫৮ বছর ধরে ছায়ানট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সবাইকে, দেশের মানুষকে সঞ্জীবিত করে চলেছে। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানবিক বাংলাদেশ গঠনের কাজে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রাখছে।

২. ৬৭ বছর ধরে সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণের কাজ করে চলেছেন—একক, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে এবং তিনি কথায়, গানে, লেখায়, সংগঠনে, আয়োজনে ও আন্দোলনে আমাদের সামনে রয়েছেন সর্বক্ষণ। এখনো এটাই আমাদের এক বড় ভরসা।

সন্‌জীদা খাতুন, আমাদের মিনু আপাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।