একটি অসফল প্রতীক্ষা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন এসে পৌঁছান। সিদ্ধান্ত হয় যে ৯ জানুয়ারি সকালে লন্ডন থেকে যুক্তরাজ্যের রাজকীয় উড়োজাহাজ কমেটে চেপে ১০ জানুয়ারি দুপুরে দিল্লি হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছাবেন। মুক্তিযুদ্ধে তেজগাঁও বিমানবন্দর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের উড়োজাহাজ বা বড় বিমান সেখানে ওঠানামা সম্ভব ছিল না। মেরামত শুরু হলেও প্রস্তুত হতে সময়ের প্রয়োজন ছিল। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী কমেট ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবে না বলে ধারণা করা হয়। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে ছোট বিমানে ঢাকা গমন করবেন বলে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। পত্রিকায় উল্লেখ ছিল, ‘স্থির হয়েছিল, ঢাকার বিমানবন্দরের রানওয়েতে রাজকীয় বিমানবাহিনীর বৃহৎ বিমান নামতে পারবে না। তাই ভারতীয় বিমানবাহিনীর একখানি বিমানে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় যাবেন। সেখান থেকে একখানি ছোট বিমান তাঁকে ঢাকা নিয়ে যাবে।’

বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরের সংবাদ প্রথম প্রকাশ পায় ৯ জানুয়ারি। পত্রিকায় উল্লেখ ছিল, ‘শেখ মুজিবুর সোমবার (১০ জানুয়ারি) দিল্লি হয়ে কলকাতা আসছেন এবং বেলা সোয়া একটায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক জনসভায় ভাষণ দিবেন। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় রোববার (৯ জানুয়ারি) দুপুরে সাংবাদিকদের এই সংবাদটি দিলে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। ... ... শ্রী রায় জানান ঐ প্রসঙ্গে এদিন টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপের ভিত্তিতেই তিনি মুজিবের আগমনের বার্তা জানাচ্ছেন।’ একই দিন অপর একটি পত্রিকা উল্লেখ করে, ‘বঙ্গবন্ধু (কলকাতা) আন্তর্জাতিক ভিআইপি লাউঞ্জে আধাঘন্টা সময় অতিবাহিত করবেন, সেখানে তিনি গভর্নর, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (জগজিৎ সিং অরোরা), বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হোসেন আলী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।’

১০ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচার প্রধান ফারুক চৌধুরী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অবস্থান করছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রাচার প্রধান মাহবুব খান। ফারুক চৌধুরী সূত্রে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনিই (মাহবুব খান) আমাকে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের পূর্বক্ষণে অবহিত করলেন আমাদের নির্ধারিত যাত্রাসূচি। দিল্লি থেকে আমরা সেই সকালেই যাব কলকাতা। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু অপরাহ্ণে একটি জনসভায় ভাষণ প্রদান করবেন।’

বঙ্গবন্ধুর আগমনের সংবাদে কলকাতায় সাজসাজ রব পড়ে যায়। ১০ জানুয়ারির সকালে বঙ্গবন্ধুর দিল্লি পৌঁছানোর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর অসংখ্য মানুষ দমদম বিমানবন্দরের দিকে ছুটতে থাকে। কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিরাসহ হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁকে যথোচিত অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরে জনতার ভিড় জমতে থাকে। সংবাদে উল্লেখ ছিল, ‘আজ ভোরে প্রভাতী সংবাদপত্র গুলিতে শেখ সাহেবের দমদম বিমান ঘাঁটিতে নামার সংবাদের সূত্র ধরে কলকাতার ও শহরতলীর হাজার হাজার মানুষ দমদম বিমান ঘাঁটিতে এসে ভিড় করে। দমদম বিমান ঘাঁটির পুরোনো ও নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন, দর্শকদের গ্যালারি, মেট অফিস, টাওয়ার ভবন ও অন্যান্য অংশে আজ ভোর থেকে শুধু মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ এত সংগঠিতভাবে শেখের আগমন প্রতীক্ষার অপেক্ষা করছিল যে বিমান ঘাঁটির কর্তৃপক্ষের প্রথমের দিকে এ নিয়ে বিশেষ কোন ভাবনাই ছিল না। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন দ্বিতীয় রানওয়ের কাছে মঞ্চ তৈরী হলো, পাতা হলো লাল কার্পেট এবং সামরিক বাদ্য তাদের প্রথম মহড়ার কাজ শেষ করলো। তখন মানুষ আর কোন বাধা মানলো না। সব বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে “শেখ মুজিব জিন্দাবাদ” “ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও” ধ্বনি দিতে দিতে ঢুকে পড়লো বিমান ঘাঁটির পরিবর্তিত রানওয়ে এলাকায়।’

সংবাদে আরও উল্লেখ ছিল, ‘জনতা ছিল মিশ্রিত ধরনের। শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ ও অসংখ্য নরনারী। বিদেশি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের আলোকচিত্রীদের সম্মুখে রোদ্রতাপ উপেক্ষা করে এই জনতা স্লোগান দিতে থাকে: শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন মন্ত্রী জয়নাল আবেদীন, সন্তোষ রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, সুব্রত মুখার্জী ও সুশীল ধড়, সোভিয়েত রাশিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকেরা, বেঙ্গল এরিয়ার জিওসি মেজর জেনারেল প্রেমাংশু চৌধুরী, কলকাতার শেরিফ ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায়, রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি আবদুস সাত্তার এবং আরও অনেকে। পশ্চিম বাংলার গভর্নর এ এল ডায়াসকে বিমানবন্দরে নিয়ে আসার জন্য একটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়। স্বল্প সময়ে বিমানবন্দরে চলে আসার জন্য পূর্বাঞ্চল আর্মির প্রধান লে. জেনারেল অরোরাও প্রস্তুত ছিলেন।

কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে পরিবহনের জন্য বিমানবাহিনীর একটি অ্যাভ্রো বিমান দমদম বিমানবন্দরের রানওয়েতে প্রস্তুত রাখা হয়। বিমানটির সার্বক্ষণিক পাহারায় ছিল সশস্ত্র প্রহরী।

বঙ্গবন্ধুর কলকাতা শহরে যাওয়ার কথা না থাকলেও কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় তাঁর প্রতিকৃতি টাঙানো হয় এবং মাল্যভূষিত করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু দমদমে নামবেন কি নামবেন না, এ নিয়ে অপেক্ষমাণ জনতা প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আশা–নিরাশার দ্বন্দ্বে দুলতে থাকে। অবশেষে বেলা একটার দিকে দমদম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর আসে যে বঙ্গবন্ধুর বিমান কিছুক্ষণ আগে লক্ষ্ণৌ ও বেনারস হয়ে কলকাতার আকাশসীমা পেরিয়ে ঢাকার উদ্দেশে চলে গেছে। পরে জানা যায় যে রাতদিন পরিশ্রম করে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী রাজকীয় বিমানটি অবতরণের জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দর প্রস্তুত করা হয়। তিনি কালবিলম্ব না করে তাঁর জনগণের মধ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য দিল্লি থেকে সরাসরি ঢাকায় উড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

দিল্লি থেকে উড়ে যাওয়ার কিছু আগে রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল উদ্যানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় শেখ মুজিব আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিককে এ দফায় কলকাতায় যেতে পারছেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি শত শত লোক কলকাতার বিমানঘাঁটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখনই গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করতে পারলাম না বলে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষও আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। আমি তাঁদের দেখার জন্য উদ্গ্রীব।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ফারুক চৌধুরী ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দিল্লি থেকে ঢাকা সফর করেন। বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর বাতিলের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্লেনে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সিদ্ধান্ত বদলের কারণগুলো। শুনলাম কলকাতা যাত্রার সূচি পরিবর্তনের কারণ ছিল তিনটি। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা প্রথম সুযোগেই তাঁর দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি, তাহলে সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় হয়তো অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত স্বাধীনতাসংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রাপথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে যথার্থ হবে একটি বিশেষ সফরে কলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।’

বঙ্গবন্ধু কলকাতায় আসছেন না, এটা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ মাইকের সাহায্যে জনতাকে বিমানবন্দর ত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। জনতার মধ্যে এর কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না, তারা ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে চারদিক মুখর করতে থাকে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানানো হয় যে রাজকীয় বিমানটি যদি ঢাকায় অবতরণে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি আবারও দমদম বিমানবন্দরে ফিরে আসবে। এ সংবাদে বিমানবন্দর আবারও সাজসাজ রবে উল্লসিত হয়।

লক্ষ্ণৌ ও বেনারস হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিমান স্থানীয় সময় বেলা একটার দিকে কলকাতার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। পশ্চিম বাংলার গভর্নর এ এল ডায়াস সে সময় বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠান। সেখানে উল্লেখ ছিল, ‘আপনার আগমনের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে ছিলাম। আমরা বুঝতে পারছি, আপনার নিজের রাজধানীতে সবার আগে যাওয়া দরকার। তবু আশা করি আপনাকে স্বাগত জানানোর সুযোগ শিগগরিই আমরা পাব। পশ্চিম বাংলার জনগণ এবং আমার পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক অভিনন্দন এবং আনন্দ জ্ঞাপন করছি।’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে গভর্নর ডায়াসকে বার্তা পাঠান, ‘আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানবেন। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে আপনার জনগণের সার্বিক সমর্থনের কথা আমরা কখনোই ভুলতে পারব না। আমাদের স্বাধীনতার প্রতি বীরোচিত সমর্থন এবং অভূতপূর্ব ত্যাগ স্বীকারের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পশ্চিম বাংলায় যাব।’

বঙ্গবন্ধুর বিমান ঢাকার মাটি স্পর্শ না করা পর্যন্ত জনতা দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে অপেক্ষমাণ অ্যাভ্রো বিমানের পাইলট জানান যে রাজকীয় বিমানটি নিরাপদে ঢাকায় অবতরণ করেছে। ধীরে ধীরে জনতা বিষণ্নমনে নিজ নিজ গৃহে ফিরে যান।

মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় সেদিনই দিল্লি থেকে জানান যে বঙ্গবন্ধু মাত্র আধা ঘণ্টার জন্য কলকাতা নামতে রাজি হননি। তিনি কলকাতায় এসে সেখানকার জনগণের সঙ্গে দেখা করবেন এবং কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দিল্লিতে এক সাংবাদিক শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেন যে কবে তিনি কলকাতা আসবেন। উত্তরে শেখ মুজিব বলেন যে ১৫ দিনের মধ্যে তিনি কলকাতা আসবেন। পত্রিকায় উল্লেখ ছিল—বঙ্গবন্ধুর ওই আশ্বাসে কলকাতার মানুষ সান্ত্বনা পায়।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্য কলকাতাবাসীর প্রতীক্ষা অসফল হলেও তাঁরা ক্ষুব্ধ হননি।

তথ্যসূত্র: # আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর (ভারত) ও হিন্দুস্তান টাইমস

# ‘জীবনের বালুকাবেলায়’, ফারুক চৌধুরী, প্রথমা প্রকাশন