একটি তৃপ্তিদায়ক মুহূর্ত

১৯৭৪ সালে আমি লন্ডন হাইকমিশনে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ওই বছরের জুন মাসে ছুটি কাটাতে ঢাকা আসি। প্রথা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যেতেই তিনি আমাকে তিনটি দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আদেশ দিলেন। প্রথম হলো বার্মায় সমুদ্র সীমারেখা সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনার জন্য যে দলটি যাচ্ছে, আমি যেন সেই দলের সদস্য হিসেবে রেঙ্গুন যাই। দ্বিতীয়, জুলফিকার আলী ভুট্টোর আসন্ন ঢাকা সফরের সময়ে আমি যেন বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে যোগ দিই এবং তৃতীয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আমি যেন তাঁর সহগামী হই। বললেন, ‘আমাদের লোকবল কম, অর্থের স্বল্পতা রয়েছে, অতএব তুমি যখন কাছে রয়েছ, এই কাজগুলো তোমাকে করতে হবে।’

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর জাতিসংঘ সাধারণ সভার ভাষণটির কথা মনে পড়ে। তখন বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর নামক এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তিনি ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদের দোসর। কিন্তু তার মাত্র এগারোটি মাস আগে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যলাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়। আমি তখন লন্ডন থেকে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। একদিন তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ আমাকে বললেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সেই তথ্য প্রতিমন্ত্রী নাকি অহেতুক আগ্রহ প্রদর্শন করছেন। বাংলা ভাষায় নাকি তাঁর জবর দখল। যেহেতু বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায়ই তিনি তাঁর ভাষণ প্রদান করবেন, সেই মন্ত্রিপ্রবর নাকি বাংলায় খসড়া একটি ভাষণ বঙ্গবন্ধুর সমীপে ইতিমধ্যে পেশ করেছেন। পরে শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁকে দিয়েছিলেন পত্রপাঠ (এই ক্ষেত্রে ভাষণপাঠ!) বিদায়। অতএব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণীত ভাষণটি নিয়ে একদিন ভোরে পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ আর আমি হাজির হলাম বঙ্গবন্ধুর দপ্তরে। কক্ষে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পড়ছেন আমাদের প্রদত্ত খসড়া ভাষণটি। এমন সময়ে তাঁর কামরায় প্রবেশ করলেন বাংলাদেশ বিমানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মুখ তুলে তাকালেন বঙ্গবন্ধু তাঁর দিকে।

কর্মকর্তাপ্রবরের প্রশ্ন, ‘স্যার, আপনার নিউ ইয়র্ক যাত্রাকালে বিমানে কী ধরনের খাবার পরিবেশন করব?’ কানাডায় ইয়াকুবু গওনের সঙ্গে বাগ্​যুদ্ধে জয়ী শেখ মুজিব এবার বাক্যহারা! আমতা আমতা করেই বললেন, ‘আমি কী জানি? ডাল-ভাত-মাছ দিয়ো আরকি। যেকোনো কিছু একটা!’ প্রসন্ন কর্মকর্তা নিষ্ক্রান্ত হলেন।

আবার প্রধানমন্ত্রী মনোনিবেশ করলেন খসড়া ভাষণপাঠে। কিছুক্ষণ পরই আবার খুলল দরজা। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা। স্যালুট জানালেন প্রধানমন্ত্রীকে।

‘হ্যাঁ বলো, কী ব্যাপার?’ ভাষণপাঠে বাধাগ্রস্ত বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন।

পুলিশ কর্মকর্তাটির জিজ্ঞাসা, ‘স্যার, আজ বিকেলে দুর্গতদের সাহাঘ্যার্থে অভিনেতা এবং অভিনেত্রীদের যে প্রদর্শনী ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার পাহারায় কারা রইবে? রক্ষীবাহিনী না পুলিশ?’

অবাক বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সামনে উপবিষ্ট ফখরুদ্দীন আহমদ আর আমিও।

‘এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার, আমি ছাড়া এই সরকারের কি আর কেউ নেই?’ মর্মাহত প্রধানমন্ত্রীর যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন।

অবস্থা বেসামাল বুঝেই আবার স্যালুট জানিয়ে বিদায় নিলেন কর্মকর্তাটি। বঙ্গবন্ধু আবার মনোনিবেশ করলেন খসড়া ভাষণপাঠে। সেদিন সেখানে বসে প্রশ্ন জেগেছিল মনে, এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? সান্নিধ্যকামী অযোগ্য আমলার বহর, না বঙ্গবন্ধুর উদারতা?

ভাষণপাঠ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাকালেন আমাদের দিকে। বললেন, ‘ভালোই তো তোমাদের ফরেন অফিসের বক্তৃতা। কিন্তু আসল কথাই যে লেখোনি। দেশে দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে, সেই কথাটিই তো আমি জাতিসংঘে “বলবার চাই”। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?’

ডাক পড়ল সাঁটলিপিকার রোজারিওর। আমাকে অদূরের সোফা দেখিয়ে বললেন বঙ্গবন্ধু, ‘ওখানে বসে আসন্ন খাদ্যাভাব সম্বন্ধে একটি লাইন তুমি আমার বক্তৃতায় জুড়ে দাও।’ তখনই বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় সন্নিবেশিত হলো নিম্নোক্ত কথাগুলো। ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাংলাদেশের অগ্রগতি শুধু প্রতিহত করেনি, দেশে প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু ভাষণের আরও একটি অংশের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শান্তিকামী বলে এই উপমহাদেশে আমরা আপস-মীমাংসানীতির অনুসারী। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে এবং অতীতের সংঘাত ও বিরোধের বদলে আমাদের তিনটি দেশের জনগণের মধ্যে কল্যাণকর সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের মহান নিকট প্রতিবেশী ভারত, বার্মা ও নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছি। অতীত থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায়ও লিপ্ত রয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী। তাঁর জাতিসংঘের ভাষণের এই অংশটি ছিল ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে কলকাতায় তাঁর বক্তৃতারই প্রতিধ্বনি।

আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিউ ইয়র্ক পৌঁছালাম ২৩ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর ভাষণ প্রদান করবেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ইংরেজি তরজমাটি আমাকেই পড়তে হবে, ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরেই ছুটে গেলাম জাতিসংঘ ভবনে তাৎক্ষণিকভাবে ইংরেজি তরজমাটি বলার কারিগরি দিকটা রপ্ত করার জন্য। জাতিসংঘের কর্মীরা আমাকে দেখিয়ে দিলেন, দোভাষীর ‘বুথে’ বসে কীভাবে তরজমাটি তাৎক্ষণিকভাবে পড়ে যেতে হয়। বুকের সাহস কিছুটা বাড়ল। তারপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কামরায় দরজা বন্ধ করে রিহার্সেল। তিনি বাংলায় তাঁর ভাষণ পড়ছেন এবং তাঁর সঙ্গে গতি বজায় রেখে বিড়বিড় করে আমিও ইংরেজি তরজমাটি বার দুয়েক পড়লাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যেহেতু তোমার ইংরেজি তরজমাটিই বেশির ভাগ মানুষ শুনবে, তুমি মনে করবে তুমিই প্রধানমন্ত্রী।’ তারপর তাঁর চোখ টিপে সেই হাসি। বললেন, ‘অবশ্য কেবল বক্তৃতা যতক্ষণ চলবে ততক্ষণের জন্য!’ আমার মনে পড়ে, ভাষণ শেষে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখায় তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি ভালো বক্তৃতা করেছ!’ তারপর পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘শাবাশ’। আমার কূটনীতিক কর্মজীবনে তা ছিল একটি অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক মুহূর্ত।

সূত্র: জীবনের বালুকাবেলায়, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪

ফারুক চৌধুরী: প্রয়াত পররাষ্ট্র সচিব