একটি নৌপথ ও সাড়ে চার লাখ মানুষের আর্তনাদ

সন্দ্বীপের জেটি ঘাট। ছবি: সংগৃহীত
সন্দ্বীপের জেটি ঘাট। ছবি: সংগৃহীত

বলছিলাম চট্টগ্রামের সাগরবেষ্টিত দ্বীপ সন্দ্বীপের যাতায়াতব্যবস্থার কথা। হাজার বছরের ঐতিহ্যঘেরা মেঘনা মোহনায় অবস্থিত প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপ। প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের বসবাস এখানে।

এ দ্বীপের রয়েছে হাজারো ইতিহাস। একটা সময় বিখ্যাত ছিল জাহাজ ও লবণশিল্পের জন্য। সবচেয়ে সুন্দর ও মজবুত জাহাজ নির্মাণ হতো এখানে, সেগুলো উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হতো। দ্বীপে জন্ম নিয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিকেরা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন সব দ্বীপকে হার মানাবে। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ জোগান দিচ্ছেন এই দ্বীপের মানুষ এবং উপজেলাভিত্তিক সন্দ্বীপ দ্বিতীয়। এত কিছুর পরও এই দ্বীপের মানুষ একটা জায়গায় অবহেলিত, আর সেটা হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা।

সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আনাসহ বিগত কয়েক বছরে সন্দ্বীপের ব্যাপক উন্নয়ন দেখা গেলেও মূল ভূখণ্ড যাওয়ার একমাত্র নৌপথ যেন প্রাচীন যুগের মতোই রয়ে গেছে। এ নৌপথের এখনো কোনো সুফল মেলেনি। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার ৭টি ফেরিঘাট থাকলেও সচল রয়েছে কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাট।

২০১২ সালে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুপাশে দুটি জেটি নির্মাণ করলেও গুপ্তছড়া অংশে কোনো কাজে আসছে না এটি। নির্মাণের ৬ মাসের মধ্যে ভেঙে পড়ে যায় এটি। সাড়ে চার হাজার ফুট দীর্ঘ জেটিটি অবশিষ্ট আছে মাত্র দুই হাজার ফুট। অথচ এই জেটি ব্যবহার বাবদ প্রতিবছর বিআইডব্লিওটিএকে ৪০ লাখ টাকা টোল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কুমিরা অংশে থাকা জেটিও ব্যবহার হচ্ছে কেবল জোয়ারের সময়। ফলে দুর্ভোগের যেন শেষ থাকে না সন্দ্বীপের মানুষের। কোমরপানিতে নেমে যেতে হয় যাত্রীদের। এরপর কাদা মাড়িয়ে পাড়ে উঠতে হয়। আবার নৌযানে ওঠার সময়ও একই অবস্থা। শুধু তা–ই নয়, স্টিমার কিংবা লঞ্চে উঠতে নামতে হলে অবৈধ লালবোট ব্যবহার করতে হয়। যার কারণে ২০১৭ সালে ২ এপ্রিল হারাতে হয়েছে ১৮টি তাজা প্রাণ। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় দ্বীপের মানুষদের।

সন্দ্বীপের জেটি ঘাট। ছবি: সংগৃহীত
সন্দ্বীপের জেটি ঘাট। ছবি: সংগৃহীত

এই রুটে প্রতিদিন ৫ থেকে ৮ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। অথচ যাতায়াতের জন্য এখানে কোনো স্থায়ী নৌযান নেই। ফলে উত্তাল সমুদ্রে কখনো অবৈধ স্পিডবোট, কখনো লঞ্চ, আবার কখনো স্টিমারে যাতায়াত করতে হয়। এই নৌপথে যেন অনিয়মের শেষ নেই। এখানে লাইফ জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও সব সময় যাত্রীদের দেওয়া হয় না, রাত্রিবেলা নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, যার কারণে দিনের বেলা নৌযান সচল থাকলেও রাত্রিবেলা অচল হয়ে পড়ে। স্টিমার কিংবা অন্য কোনো নৌযানে ওঠার জন্য চলছে অবৈধ লালবোট, সেই লালবোটে চলে বকশিশের নামে চাঁদাবাজি। দুই পাড়ে ১০ টাকা করে ২০ টাকা দিতে হয় তাদের। বকশিশ আদায়কে কেন্দ্র করে প্রায়ই যাত্রী ও বোট কর্মচারীদের মধ্যে হাতাহাতি বা মারামারির ঘটনাও ঘটে। যারা বকশিশ দিতে চায় না, তাদের নানাভাবে নাজেহাল করে থাকে বোটের কর্মচারীরা। নেই মানসম্মত টয়লেট, পর্যাপ্ত যাত্রীছাউনির অভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় যাত্রীদের। যাত্রীর মালামাল নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকায় অতিরিক্ত টিকিট খরচ দিয়ে মালামাল আনা-নেওয়া করতে হয়। এ ছাড়া নারী পুরুষের আলাদা টিকিট কাউন্টার নেই বলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পুরোনো নৌযান হওয়ায় মাঝপথে আবার বিভিন্ন সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। শীতকালে যাত্রী পারাপার নিরাপদ হলেও বর্ষাকালে কঠিন অবস্থা দাঁড়ায়। বর্ষায় যে স্টিমার দেওয়া হয়, অনেক সময় তার টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখে প্রায়ই স্পিডবোটে যেতে বাধ্য করে ঘাটের দায়িত্বরতরা।

এ ছাড়া স্পিডবোটে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ঝুঁকি নিয়ে মালবাহী বোটে যাত্রী আনা–নেওয়াসহ নানান অভিযোগ তো আছেই। ফলে একপ্রকার জিম্মি হয়ে ওই পথে আসা–যাওয়া করতে হচ্ছে হাজারো যাত্রীকে। এসব কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে নৌদুর্ঘটনা। এর আগেও একাধিকবার নৌদুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এ দ্বীপের মানুষ। প্রতিবার দুর্ঘটনা শেষে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, কিন্তু দোষীদের বিচার হয় না।

সি অ্যাম্বুলেন্স থেকেও নেই
এবার আসি সি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে, ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি সি অ্যাম্বুলেন্স দিলেও চালক ও জ্বালানির অভাবে ৩ বছর পড়ে থাকে এটি। বহুদিন অচল থাকার পর ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে একজন চালক ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় এক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় এটি। এরপর আর চালু হয়নি। ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরেকটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। আগেরটির মতো এটারও চালক ও জ্বালানি তেলের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে রোগীদের জন্য সি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও এক দিনের জন্যও সেটি ব্যবহার করা যায়নি। বর্তমানে এটি সড়কের পাশে খালে ফেলে রাখা হয়েছে শুধু প্রদর্শনীর জন্য।

পানি মাড়িয়ে নৌযানে উঠতে হয়। ছবি: সংগৃহীত
পানি মাড়িয়ে নৌযানে উঠতে হয়। ছবি: সংগৃহীত

সন্দ্বীপে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় এই উত্তাল সমুদ্রে এভাবে রোগীদের চট্টগ্রামে আনা-নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কুলিদের টাকা দিলে তারা বৃদ্ধ বা অসুস্থ লোকজনকে কাঁধে করে পৌঁছে দেয়। অনেক সময় ভোগান্তির কারণে যাত্রাপথে রোগী মারা যায়। ৬ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত সন্দ্বীপের এক যুবককে রাত ১১টায় চট্টগ্রাম নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হলে, সি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে এই উত্তাল সমুদ্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লালবোটে করে নেওয়া হয়। কৃত্রিম অক্সিজেন দেওয়া একজন রোগীকে জরুরি অবস্থায় এভাবে লালবোটে করে নেওয়া সত্যি মর্মান্তিক। যে লালবোট অন্যান্য জায়গায় জেলেদের মাছ ধরার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে, সেটি সন্দ্বীপে জরুরি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

অন্যদিকে ২০১২ সালে গুপ্তছড়া ঘাটে নির্মিত জেটিটি বিকল হয়ে যাওয়ায় তার পাশে বর্তমানে নতুন আরেকটি জেটির কাজ চলছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু অতিরিক্ত চর জাগার কারণে এ জেটিও সাধারণ মানুষের তেমন কাজে আসবে না। নতুন জেটির দৈর্ঘ্য প্রথমে ছিল দশমিক ৬ কিলোমিটার। প্রকল্প ছিল ৪৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার। পরে তা দশমিক ১ কিমি বাড়িয়ে প্রকল্প আনা হয় ৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকায়। আরও দশমিক ৫ কিমি বাড়াতে চায় বিআইডব্লিওটিএ। কিন্তু তারপরও সুফল মিলবে বলে মনে হয় না দ্বীপবাসীর। এর জন্য আগের জেটির মতো সাধারণ মানুষকে আবার টোল গুনতে হবে। ওঠানামার কষ্ট লাঘবে এখন বিকল্প হিসেবে কাজ করছে কেওড়া কাঠের নির্মিত সেতু। দ্বীপের মানুষের শেষ ভরসা এই কাঠের সেতু। কিন্তু পিচ্ছিল হওয়ায় সেটা যেন আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। জোয়ার থাকলে কাঠের সেতুতে চলাচল করা যায়, তা–ও শিশু বৃদ্ধাদের জন্য সেটা কষ্টকর। কিন্তু ভাটা থাকলে দেড় থেকে দুই শ গজ পথ কাদা মাড়িয়ে পাড়ে আসতে হয়। রোগীদের জন্য তো সেটা জীবনমরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

সি অ্যাম্বুলেন্স অচল হয়ে পড়ে আছে। ছবি: সংগৃহীত
সি অ্যাম্বুলেন্স অচল হয়ে পড়ে আছে। ছবি: সংগৃহীত

নিয়মিত চট্টগ্রামে যাতায়াতকারী অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট খাদেমুল ইসলাম জানান, সাড়ে চার লাখ দ্বীপবাসীর জন্য বরাদ্দকৃত সি অ্যাম্বুলেন্স গুপ্তছড়া ঘাটের ডাঙ্গায় পড়ে আছে। নিরাপদ নৌযান না থাকায় রোগীকে লালবোটে করে রাতের অন্ধকারে চট্টগ্রাম নেওয়া হচ্ছে। এভাবে আর কত দিন চলবে! আমাদের এ দুর্ভোগের সমাধান কি কেউ দিতে পারবে না! সারা দেশে যখন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে, তখন ব্যতিক্রম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নৌপথ এখনো নিরাপদ হয়নি। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়া ওঠা এই জনপদ যোগাযোগব্যবস্থায় যেন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার আগে ছিল হেলিকপ্টার সার্ভিস। পরবর্তীকালে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসে বিআইডব্লিউটিসির বড় বড় জাহাজ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেগুলোও এখন বন্ধ। চর সৃষ্টি হওয়ায় সরকারি জেটিগুলোও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে দ্বীপের সাড়ে চার লাখ মানুষ। ভোগান্তি যেন তাদের পিছু ছাড়ছেই না। সন্দ্বীপের মাননীয় সাংসদ বারবার সংসদে এই বিষয় উপস্থাপন করলেও এখনো কোনো সুরাহা মেলেনি। যদি এই নৌপথ নিরাপদ করা যায়, তাহলে সন্দ্বীপ হবে অন্যতম এক পর্যটন নগরী। গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা। তাই সরকারের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বীপবাসীর কষ্ট লাঘবে নৌযাতায়াত নিরাপদ করা।