চীনের হেবেই থেকে পদ্মার বুকে

পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলার ও ৪১টি স্প্যানের প্রতিটির নম্বর দেওয়া আছে। ১ নম্বর পিলার ও স্প্যানের শুরু মাওয়া প্রান্ত থেকে। শেষ পিলার ও স্প্যান জাজিরায়। প্রতিটি স্প্যানের মালামাল আলাদা। একটার মালামাল অন্যটাতে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য যে স্প্যানের মালামাল আগে এসেছে, সেগুলোই আগে বসানো হয়েছে। একইভাবে যেখানে পিলার আগে নির্মাণ হয়েছে, সেখানকার স্প্যান আগে নিয়ে আসা হয়েছে।

৪১ নম্বর স্প্যানটি নিয়ে আসা হচ্ছে সংযোগস্থলের দিকে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মাওয়া প্রান্তেছবি: সাজিদ হোসেন

এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল স্প্যান। একেকটি স্প্যান বসেছে, আর চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে সেতু। এ স্প্যানগুলো স্টিলের তৈরি। প্রতিটি স্প্যানেরই তৈরি থেকে শুরু করে বসানো পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রার ইতিহাস রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শত কর্মীর হাত, প্রকৌশলীদের মেধা ও জ্ঞান।

প্রথমে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের কারখানায় স্টিলের প্লেট আসে।

সেগুলো কেটে কেটে তৈরি করা হয় মেম্বার। সেই মেম্বারগুলো চীনেই দুই দফা রং করা হয়, যা দেখতে অনেকটা সোনালি রং ধারণ করে। এরপর মাদার ভেসেলে করে সমুদ্রযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের পথে।

বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে আসতে সময় লেগেছে ২১-৩০ দিন। এরপর শুল্ক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে লেগেছে আরও সপ্তাহখানেক। এরপর বার্জে করে বিভিন্ন অংশ মাওয়ায় আসে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে চলে এসেছে। কখনো কখনো আরও বেশি সময় লেগেছে। মাওয়ায় নামানোর পর মেম্বারগুলোর জায়গা হতো নদীতীরের নির্মাণমাঠে।

নির্মাণমাঠে প্রথমে ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপে চলে যায় এসব কাঠামো। একেকটা অংশ জোড়া দেওয়ার কাজ করা হয় সেখানে। এরপর থ্রিডি ওয়ার্কশপে নেওয়া হয় চূড়ান্ত ওয়েল্ডিং করার জন্য। তখনই স্প্যানটি দেড় শ মিটারের পরিপূর্ণ রূপ নেয়। এরপর পেইন্টিং শপে নিয়ে ধূসর রং করা হয়। শুরু হয় পিলারে বসানোর অপেক্ষা।

রং করা সম্পন্ন হয়ে গেলে তদারকে নিয়োজিত বিদেশি পরামর্শকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সন্তুষ্ট হলেই পিলারে বসানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তারপর ঠিকাদারের প্রকৌশলীরা স্প্যান বসানোর দিন-তারিখ ঠিক করে সেতু বিভাগ ও পরামর্শকদের অনুমতি চাইতেন।

সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর জন্য গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঠিকাদারের পক্ষ থেকে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের এবং পরামর্শকের অনুমতি চাওয়া হয়। অনুমতি মেলে সঙ্গে সঙ্গেই।

গত বুধবার বেলা একটার দিকে ভাসমান ক্রেন ‘টিয়ানি’তে তোলা হয় স্প্যানটি। এরপর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে নেওয়ার জন্য রওনা হয় ক্রেন। ১০০ মিটার যাওয়ার পর ক্রেনের তারে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ফিরে আসতে হয় নির্মাণমাঠের পাশের জেটিতে। ত্রুটি সারিয়ে বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে পুনরায় শেষ স্প্যান নিয়ে রওনা দেয় টিয়ানি। ৪০ মিনিট পর সেই দুই পিলারের মাঝ বরাবর একটু দূরে দাঁড়ায় টিয়ানি।

চলছে স্প্যান সংযোগ করার কর্মকাণ্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মাওয়া প্রান্তে
ছবি: প্রথম আলো

ভাসমান ক্রেনটির পাহারায় ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও পরামর্শকের অনুমতি ও ঠিকাদারের লোকজনের পুরোপুরি প্রস্তুতির পরও অনেক সময় পরিকল্পনামতো স্প্যান বসানো যায়নি। গত ১৬ নভেম্বর স্প্যান বসাতে গিয়ে ক্রেনে ত্রুটি দেখা গেলে তা বসানো সম্ভব হয়নি। ঘন কুয়াশার কারণেও একাধিকবার স্প্যান বসানোর কাজ পিছিয়েছে।

পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলার ও ৪১টি স্প্যানের প্রতিটির নম্বর দেওয়া আছে। ১ নম্বর পিলার ও স্প্যানের শুরু মাওয়া প্রান্ত থেকে। শেষ পিলার ও স্প্যান জাজিরায়। প্রতিটি স্প্যানের মালামাল আলাদা। একটার মালামাল অন্যটাতে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য যে স্প্যানের মালামাল আগে এসেছে, সেগুলোই আগে বসানো হয়েছে। একইভাবে যেখানে পিলার আগে নির্মাণ হয়েছে, সেখানকার স্প্যান আগে নিয়ে আসা হয়েছে।

এ জটিলতার কারণে টানা পিলারের ওপর স্প্যান বসেনি। মাঝেমধ্যে ফাঁকা রেখেও স্প্যান বসানো হয়েছে।

শেষ স্প্যানের মালামাল গত ১৪ মে আসে। এরপর জোড়া লাগানোর কাজ সম্পন্ন হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বসানোর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা যুক্ত হলো।