একটি হ্রদের সৃষ্টির কাহিনি

চাম্বি হ্রদের পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। এর চারপাশে সবুজ অরণ্য। তাতে পুরোনো বৃক্ষের পাশে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বড় হচ্ছে হাল আমলের নতুন নতুন জাতের ফলের গাছ। এখানে কোথাও খড়ে ঢাকা পানের বরজ, আবার কোথাও শত শত ডালপালা বিস্তারকারী বট। তারই পাশে হয়তো সূর্যঢাকা আকাশছোঁয়া মেহগনির বিস্তার। সবুজের কত বৈচিত্র্য, পাতার কত আকার। সেই বিচিত্র সবুজের ভেতর থেকে গ্রীষ্মের দুপুরে বউ কথা কও বলে একটি পাখি ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে। কিন্তু তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না। তবে শীতে এখানে দূর দেশের অতিথি পাখির মেলা বসে। সম্প্রতি গ্রীষ্মের এক দুপুরে নৌযানে ঘুরতে ঘুরতে হ্রদের মাঝখানের ছোট একটা দ্বীপে দাঁড়িয়ে মনে হলো সৌন্দর্য যেন মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে। দ্বীপটির নাম মায়া দ্বীপ। ওখান থেকে চোখে পড়ে পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি গোলঘর। গোলঘরে বসে বিস্তীর্ণ সবুজ আর আবছায়া পাহাড়ের রহস্য থেকে চোখ সরে না।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে চুনতি শাহ গেট থেকে ইসহাক সড়ক দিয়ে পূর্ব দিকে ১২ কিলোমিটার গেলেই চাম্বিহ্রদ। এই ১২ কিলোমিটার পথের দুই পাশে দিগন্তপ্রসারী ধানখেত, মানুষের ঘরবাড়ি আর বাঁশঝাড়, বহু বছরের পুরোনো সব গাছপালা।

লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা, ফারাঙ্গা ও নারিশ্চা গ্রাম ও পাশের পার্বত্য বান্দরবানের আজিজনগর ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বি গ্রাম পর্যন্ত ১০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদের অস্তিত্ব চার বছর আগেও ছিল না। এটি ছিল একটি পাহাড়ি ছড়া। হ্রদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পার্বত্য বান্দরবানের পাহাড়ে কয়েকটি সক্রিয় ঝরনা থেকে চাম্বির জন্ম। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীন চাম্বিতে রাবার ড্যাম বসিয়ে এই হ্রদের উত্থান ঘটানো হয়। এর ফলে শুকনো মৌসুমে চাষাবাদের অনুপযোগী প্রায় ৪০০ হেক্টর জমি চাষের উপযোগী হয়েছে। সাত শতাধিক কৃষক লাভবান হয়েছেন। আমাদের সঙ্গে কথা হয় পানত্রিশা গ্রামের কৃষক ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে। তার স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। পরিবারের ১০ জন সদস্য নিয়ে তিনি খুব কষ্টে ছিলেন। বাঁধের সুবিধা ভোগ করে তিনি দুই একর জমিতে ধান, গম, ভুট্টা ও মৌসুমি সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন। সবচেয়ে মজার কথা, পুরো এলাকাটি সৌন্দর্যের এক অনুপম উদাহরণ হয়ে উঠেছে এবং ভ্রমণপিয়াসী মানুষের জন্য তৈরি হলো নতুন স্পট।

এখন শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ আর এখানে পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা তৈরির সামগ্রিক কাজ পরিচালনা করছে চাম্বি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির ৬৪৭ জন সদস্য। তাঁরা সবাই রাবার ড্যামের কারণে উপকারভোগী। সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মাস্টার মাহবুবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এম এ লতিফ। চাম্বি হ্রদে গিয়ে সভাপতির দেখা পাই। তিনিই চাম্বিহ্রদের উৎপত্তির কথা জানালেন, চাম্বিছড়ায় রাবার ড্যাম বসানোর চিন্তাভাবনা হচ্ছিল সেই ১৯৯৮ সাল থেকে। চুনতি ইউনিয়ন পরিষদের তখনকার চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন বহু চেষ্টার পরও সরকারের রাবার ড্যাম প্রকল্পে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিনের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি নতুনভাবে সরকারের রাবার ড্যাম প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৬ সালে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে তিনি এটি উদ্বোধন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে এলজিইডি ব্যয় করে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে এটিকে ঘিরে পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক চাম্বিহ্রদে ঘুরতে আসেন বলে জানান সমিতির সভাপতি।

চাম্বিছড়ার ওপর যেখানে ২০ মিটার দৈর্ঘ্য রাবার ড্যাম দেওয়া হয়েছে, তার ওপর রয়েছে একটি পদচারী–সেতু। সেই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে উজানে প্রায় দুই কিলোমিটার বিস্তৃত হ্রদ। চারপাশের নিবিড় গাছপালা আর স্বচ্ছ পানিতে চোখ জুড়িয়ে যায়। হ্রদটিতে স্পিডবোটে ঘুরে বেড়ানো যায়। যাওয়া যায় চাম্বির উৎসের দিকে। তবে ক্রমে উজানের দিকে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন এলাকাবাসী। কারণ, হ্রদের তিনদিকে পাহাড়ি বনভূমিতে রয়েছে হাতির চলাচল। হরিণ ও বানরেরও দেখা মেলে। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে গুইসাপসহ নানা জাতের বন্য প্রাণী।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, হ্রদটিকে এখন মৎস্য প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। শৌখিন মৎস্য শিকারিরা এখানে টিকিট কেটে মাছ শিকার করেন। রুই কাতলা মৃগেল নিয়ে ঘরে যান। চাম্বি হ্রদের চারপাশে তিনটি পানির কৃত্রিম ফোয়ারা বানানো হয়েছে। রয়েছে পশুপাখির ভাস্কর্য, স্পিডবোট, প্যাডেল বোট, রাবার বোট, লাইফ বোট ও নৌকা। সম্প্রতি যুক্ত করা হয়েছে ফ্যামিলি ট্রেন। সম্প্রতি এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি পারিবারিক রেল। চালু হয়েছে একটি রেস্টুরেন্টও। অতিথিদের অবকাশের জন্য রয়েছে বিশ্রামাগার। রয়েছে মনোরম পিকনিক স্পটও।

চাম্বি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মাস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চাম্বি রাবার ড্যাম স্থাপনের ফলে এ অঞ্চলের কৃষির ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি পর্যটন-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সমিতির সদস্যদের অর্থায়নে পর্যটন খাতে আমরা এ পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি।’ তিনি জানান, পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচটি কটেজ, সুইমিংপুল, ওয়াটার রাইড, খেলার মাঠ, উন্নত রেস্টুরেন্ট করার পরিকল্পনা আছে।

চাম্বি হ্রদ কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষের মুখেও হাসি ফোটাবে খুব শিগগিরই। এখানকার জীব ও উদ্ভিদ প্রজাতিকে নিরাপদে রেখে বিকশিত হোক পর্যটনশিল্প। অতিথি পাখির মতো মানুষও আসুক সৌন্দর্যের তৃষ্ণা নিবারণে।