একসঙ্গে দুই মামলায় সুবিধা পায় আসামি

নৌ দুর্ঘটনার মামলা নৌ চলাচল অধ্যাদেশে করার জন্য ১৯৯৪ সালে নির্দেশনা দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জানে না বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশ।

নৌ দুর্ঘটনায় বাবা, মা ও দুই বোনকে হারিয়ে ৯ বছরের শিশু মীমের কান্না যেন থামে না। মাদারীপুরের পদ্মা নদীতে বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ৩ মে দুপুরে কাঁঠালবাড়িতেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

নৌপথে একই দুর্ঘটনায় দুই আইনে দুই মামলা করার কারণে সুবিধা পাচ্ছে আসামিপক্ষ। ১৯৭৬ সালের অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নৌপথে দুর্ঘটনার মামলার বিচার হওয়ার কথা নৌ আদালতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একই ঘটনায় নৌ আদালতের পাশাপাশি নিয়মিত বিচারিক আদালতেও ফৌজদারি অপরাধের বিচার চলছে।

এই সুযোগই নিচ্ছে আসামিপক্ষ। তারা একই ঘটনায় দুই মামলার বিচারের মুখোমুখি করার অজুহাত দেখিয়ে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে যাচ্ছে।

পদ্মায় গত সোমবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যুর পর নৌ দুর্ঘটনায় বিচারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এর আগে ২০১৪ সালে একই নৌপথে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চডুবির ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ ও ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে দুটি মামলা হয়। হাইকোর্ট এ ঘটনায় নৌ আদালতে চলমান মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন বলে জানিয়েছেন নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের ২৬ ধারা অনুযায়ী, একই ঘটনার জন্য দুই আইনের অধীনে যদি অপরাধ হয়, তখন বিচার চলবে একটি আইনের অধীনে। জেনারেল রুলসই হলো, পরের আইনটা আগের আইনের থেকে প্রাধান্য পায়। বিশেষ আইন সব সময় প্রাধান্য পাবে।

নৌ দুর্ঘটনায় সাধারণ আইনে মামলা করার প্রবণতা ১৯৯৪ সালেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছিল। ওই বছর মন্ত্রণালয়টি নৌ দুর্ঘটনায় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা না করার জন্য দেশের সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, নৌ দুর্ঘটনায় নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ না নিয়ে দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় থানা মামলা নিয়ে থাকে, যা মোটেও অভিপ্রেত নয়।

অবশ্য এখনো নৌ চলাচল অধ্যাদেশের বাইরে দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করছে নৌ পুলিশ। গত সোমবার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়ায় স্পিডবোট দুর্ঘটনার মামলাটিও দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় করেছে পুলিশ। এর আগে গত বছরের ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ড নামের একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দণ্ডবিধিতে মামলা করা হয়। আর নৌ চলাচল অধ্যাদেশে নৌ আদালতে মামলা করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা বেল্লাল হোসাইন বলছেন, নৌ আদালতে বিচারাধীন কয়েকটি মামলায় উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ পেয়েছে আসামিপক্ষ।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন মনে করেন, নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ প্রাধান্য পাবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একই নৌ দুর্ঘটনার একই ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ার কারণে নৌ আদালতে যেসব মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে, সেগুলো যাতে চালু হয়, তা নিশ্চিতে খুব শিগগির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

দেশে নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত মামলার বিচারের জন্য ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ভবনে একটিমাত্র নৌ আদালত রয়েছে। নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ আদালত গঠিত হয়। এই অধ্যাদেশে নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত মামলা, তদন্ত ও বিচারের নিয়মকানুন বিশদভাবে বলা আছে।

নৌ দুর্ঘটনার মামলা নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি জানতেন না বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক ও নৌ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আতিকুল ইসলাম। তাঁরা বলেন, এ বিষয়ে তাঁরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

আটকে আছে কোন কোন মামলা

নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পিনাক-৬ ছাড়াও একই ঘটনায় দুই মামলার কারণে স্থগিতাদেশ এসেছে এমভি মিরাজ, এমভি বন্ধনসহ কয়েকটি মামলায়।

২০১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রায় আড়াই শ যাত্রী নিয়ে উত্তাল পদ্মার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ডুবে যায় এমভি পিনাক-৬। এ দুর্ঘটনার পর ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আজও সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ ৬৩ জনের।

মুন্সিগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিজেএম) সূত্রে জানা যায়, মামলার ছয় আসামির মধ্যে লঞ্চের সুকানি গোলাম নবী বিশ্বাস পলাতক রয়েছেন। বাকিরা জামিনে রয়েছেন। গত বছরের শুরুতে মামলা চার্জ গঠন করা হয়। তবে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। এ ঘটনায় নৌ আদালতের মামলাটির বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে।

২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সিগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ নামের একটি লঞ্চডুবিতে মারা যান ২২ যাত্রী। নৌ আদালতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেঘনায় বাল্কহেডের ধাক্কায় এমএল সারস নামের একটি লঞ্চডুবিতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নৌ আদালতের মামলার বিচারকাজ স্থগিত হয়ে আছে বলে জানান ওই আদালতের প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা বেল্লাল হোসাইন।

দীর্ঘসূত্রতা থাকার আরও কারণ

নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং কার্যালয়ের গত এপ্রিলের তথ্যানুযায়ী, এই আদালতে বিচারাধীন আছে ২ হাজার ৬টি মামলা। এগুলোর মধ্যে নৌ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত মামলা রয়েছে ১৪৭টি।

নৌ আদালতে ২৫ বছর মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক প্রসিকিউটিং অফিসার পারভিন সুলতানার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নৌ দুর্ঘটনায় অনেক সংস্থাকেই মামলা করার সুযোগ দেওয়া আছে। তারা তা প্রয়োগও করে। তবে এ ধরনের মামলা বিশেষ আদালতে না করলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হয়। নৌ মামলা নৌ আদালতে করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ হলো, নৌ বিষয়ে এটি বিশেষায়িত আদালত।

উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ আদালতে ন্যূনতম দুজন ন্যায় নির্ধারক উপদেষ্টা থাকবেন, যাঁদের মধ্যে একজনের নৌ-বিষয়াদির ওপর জ্ঞান থাকতে হবে।

শুধু উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নয়, তদন্তে দেরি করা, যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না করা, রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতা, নজরদারির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে নৌ দুর্ঘটনার বিচার ঝুলে থাকে বলেও জানান নৌ আদালতের বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং কার্যালয় থেকে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মামলা পরিস্থিতির একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এতে মামলার দীর্ঘসূত্রতার একটি চিত্র উঠে আসে। দেখা যায়, তখন ৯ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা ছিল ৫২টি। এগুলোর মধ্যে একটি মামলা হলো ২০১২ সালের মার্চে মুন্সিগঞ্জে এমভি শরীয়তপুর-১ নামের একটি লঞ্চ ডোবার ঘটনার। এতে মারা যান ২৭ জন। এ ঘটনায় নৌ আদালতে মামলায় সাক্ষী গ্রহণ শেষ হয়নি। কারণ হলো, যথাসময়ে সাক্ষী উপস্থিত করা যাচ্ছে না।

সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর

বিদ্যমান নৌ চলাচল অধ্যাদেশ আইনে দোষী সাব্যস্ত হলেও অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে পাঁচ বছর এবং সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র ৫ লাখ টাকা। নৌ আদালতে মামলা পরিচালনাকারী প্রবীণ আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যত নৌ দুর্ঘটনার মামলার বিচার শেষ হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামি সাজা হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ কম। আর ক্ষতিপূরণ তো একেবারেই কম।’

২০০৯ সালে ভোলায় এমভি কোকো-৪ নামের লঞ্চটি ডুবে মারা যান ৮৩ জন। ২০১৭ সালে এ ঘটনায় করা মামলার বিচার শেষ হয়। রায়ে ৯ আসামির প্রত্যেককে চার বছর করে কারাদণ্ড ও লঞ্চের মালিককে ৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সরকার ২০১৫ সালে নতুন করে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। নতুন আইনে সাজা ও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি উঠেছে। নতুন করে আইন করার কারণ হলো, ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক ফরমান দ্বারা জারি করা অধ্যাদেশ অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। অবশ্য ২০১৩ সালে বাতিল হওয়া ৫৪৫ অধ্যাদেশের বিল শর্তসহ পাস হয়। শর্তটি ছিল, অধ্যাদেশগুলো নতুন করে আইনে পরিণত করতে হবে।

নতুন আইন এত দিনেও হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আইন তৈরির নানা ধাপ রয়েছে। অংশীজনদের মতামত নিতে হয়। এসব কারণে দেরি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এ বছরের মধ্যে নৌ চলাচল আইনটি পাস হবে।’

‘নজরদারি নেই’

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২০ সালে সারা দেশে ১৮৩টি নৌ দুর্ঘটনায় মারা যান ৩১৩ জন। নিখোঁজ রয়েছেন ৩৭১ জন। দেশে সাম্প্রতিক কালে বড় কয়েকটি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে গত বছরের ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ড নামের একটি লঞ্চডুবিতে মারা যান ৩২ জন। গত এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবিতে মারা যান ৩৪ জন। এরপর ঘটল গত সোমবারের স্পিডবোট দুর্ঘটনা, এতে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌ যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মীর তারেক আলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নৌ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি না কমার পেছনে বড় কারণ কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, তবে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না। তিনি বলেন, ‘বাস্তবে নৌ দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পুরো নৌপরিবহন ব্যবস্থার ওপর যে নজরদারি প্রয়োজন, তা সেভাবে নেই। যত দিন নৌ দুর্ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হবে, তত দিন এই দুর্ঘটনা কমবে, সেটি বিশ্বাস করা অমূলক।’